ভালোবাসার ক্রিকেটে থাকুক অভিমান, অনুতাপও

ওয়ানডে সিরিজে জয়ের দারুণ আনন্দ যেমন আছে, আছে টেস্ট সিরিজে হারের হতাশাও। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তাই বাংলাদেশ দল ফিরছে মিশ্র অনুভূতি নিয়েছবি: এএফপি

সব মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাংলাদেশ দলকে আপনি ১০-এ কত নম্বর দেবেন? যাঁরা শেষটাই বেশি মনে রাখছেন, তাঁদের কলমে নম্বর বেশি ওঠার কথা নয়। টেস্ট সিরিজে এমন বাজে পারফরম্যান্সের পর আবার নম্বর কি!

আর যদি ওয়ানডে সিরিজটাও বিবেচনায় রাখেন, তখন? দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগে বাংলাদেশের কোনো জয়ই ছিল না। অথচ এবার এসে সিরিজই জিতে গেল, সেটিও পূর্ণশক্তির দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে! দ্বিতীয় ওয়ানডেটা হারলেও জোহানেসবার্গের উইকেট সেদিন কেমন ছিল, সেটি তো দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট পণ্ডিতেরাই বলেছেন। কাজেই এখানে তামিম ইকবালের দলকে ১০-এ ১০ না দিলে নিশ্চিতভাবেই পরীক্ষক হিসেবে আপনি নিরপেক্ষ নন।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ
ছবি: এএফপি

টেস্ট সিরিজেও যে বাংলাদেশ দল একেবারেই নম্বর পাবে না, তা নয়। ডারবানের প্রথম টেস্টটার কথাই আরেকবার মনে করে দেখুন। ম্যাচের চতুর্থ দিন বিকেল পর্যন্তও কি কেউ ভেবেছিল, এই টেস্ট বাংলাদেশ ২২০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারতে যাচ্ছে? বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর আগপর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার যতটুকু আশা ছিল, ঠিক ততটুকুই আশা ছিল বাংলাদেশেরও। এই দেশে এর আগে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটটাই–বা কবে এত ভালো খেলেছে! শুধু একটা ইনিংসের ব্যাটিং দিয়ে পুরো টেস্টকে মূল্যায়ন করলে ভিন্ন কথা, নইলে ওই টেস্টেও বাংলাদেশকে ১০-এ ৭/৮ না দেওয়ার কোনো কারণ নেই।

এবার আসা যাক পোর্ট এলিজাবেথের শেষ টেস্টে। এককথায় জঘন্য ক্রিকেট খেলল বাংলাদেশ। দুই ইনিংসেই চরম বাজে ব্যাটিং যেন ভুলিয়েই দিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় এবারের সফরটা কী দুর্দান্তভাবেই না শুরু হয়েছিল! সফরের রিপোর্ট কার্ডে তাই শেষের অন্ধকারের ছায়াটাই হয়তো বেশি পড়ছে। কিন্তু ওয়ানডে আর প্রথম টেস্টের চার দিন মাথায় না রেখে নম্বর দিলে সেটিও নিরপেক্ষ বিচার হবে না।

ইয়াসির আলীর বোল্ড হওয়ার দৃশ্যটা হয়তো বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের প্রতীকি। মহারাজ-হারমারদের কোনো জবাব শুধু ইয়াসির কেন, বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানেরই ছিল না
ছবি: এএফপি

সাদা বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরেই ভালো দল। বিশেষ করে ঘরের মাঠে তাদের কাছে এখন জিম্বাবুয়ে যা, ভারত-অস্ট্রেলিয়াও তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। ফলাফলে তো শেষ পর্যন্ত জয় বা পরাজয়ই থাকে, তার আগপর্যন্ত বাংলাদেশ নিজেদের জয়ী ভাবতে শিখে গেছে, মানসিকতার এই পরিবর্তনই উদ্‌যাপন করার মতো এক পাওয়া। টেস্টে সে জায়গায় আসতে বাংলাদেশের আরও সময় লাগবে। আর সেটি শুধু ক্রিকেটারদের সামর্থ্যের কারণেই নয়। লাল বলের খেলাটার সঙ্গে ক্রিকেটারদের মতো এখনো যে মানিয়ে নিতে পারেনি বাংলাদেশও! টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস, টেস্ট সংস্কৃতি এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামোরও লাল বলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। একটা গাছের মূল এখনো মাটির অত গভীরে যায়নি, গোড়ায় পানি ঢালার কাজটাও ঠিকঠাক হয় না, সে গাছের ফলে-ফুলে ভরে ওঠার আশাটা বাড়াবাড়িই।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের ৫৩ আর ৮০ রানের ইনিংস দুটিকে সমালোচনার ছুরিতে কাটাকুটি করার পরও তাই এটা মেনে নিতেই হবে, টেস্টে নিয়মিত সাফল্য পেতে বাংলাদেশের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। টেস্টে তারা মাঝেমধ্যে ভালো খেলবে, জিতবে , ড্র করবে—এটাকেই উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়া ধরে নিয়ে হার মেনে নেওয়ার মানসিকতাও রাখতে হবে।

অনেকের মধ্যে যেভাবেই হোক এই বোধ ঢুকে গেছে যে তাঁরা যা–ই করুন না কেন, সেসব নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না, এমনকি ৫৩ আর ৮০ রানে অলআউট হলেও না। ভালো খেললে প্রশংসা নেবেন কিন্তু খারাপ খেললে সমালোচনা তাঁদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, ক্রিকেট না–বোঝা লোকদের কাজ।

তারপরও সমালোচনা হয় এবং সেটি ক্রিকেটারদের কাছে মানুষের প্রত্যাশার কারণেই হয়। এই ক্রিকেটাররাই ভালো খেলে স্বপ্ন দেখান আরও ভালো কিছুর। এরপর যখন তাঁরাই আবার শিশুসুলভ ব্যাটিং করে ৫৩ আর ৮০ রানে গুটিয়ে যান, জ্বালা তো হবেই। কিন্তু সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের সেই জ্বালার খবর ক্রিকেটাররা কতটা রাখেন? তাঁরা কি জানেন, এই জ্বালা খেলাটার প্রতি মানুষের ভালোবাসাজনিত অভিমান থেকে? সবার সমালোচনায় ক্রিকেটীয় যুক্তি না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে অভিমানের উদ্‌গিরণ কিন্তু ওই এক জায়গা থেকেই—ভালোবেসে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা।

সেই ভালোবাসার উপজাতকে শত্রুভাবাপন্ন মনে নিয়ে সবাইকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করাটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এই মুহূর্তে বড় সমস্যা বলে মনে হচ্ছে। তাঁরা মাঠের পারফরম্যান্সে যতটা না পরিণত হয়েছেন, ঠিক ততটাই অপরিণত রয়ে গেছেন এই জায়গাতে। অনেকের মধ্যে যেভাবেই হোক এই বোধ ঢুকে গেছে যে তাঁরা যা–ই করুন না কেন, সেসব নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না, এমনকি ৫৩ আর ৮০ রানে অলআউট হলেও না। ভালো খেললে প্রশংসা নেবেন কিন্তু খারাপ খেললে সমালোচনা তাঁদের কাছে অগ্রহণযোগ্য, ক্রিকেট না–বোঝা লোকদের কাজ।

টেস্ট সিরিজে প্রাপ্তি বলতে প্রথম ম্যাচে মাহমুদুল হাসানের শতক
ছবি: এএফপি

বাজে পারফরম্যান্সের পর কতটা অনুশোচনায় তাঁরা পোড়েন, সেটি নিয়ে তো খোদ ক্রিকেটের সঙ্গে থাকাদের মধ্যেই প্রশ্ন। মাঠে ভুল করে আসার পর কোচ কী বলছেন, তার চেয়েও ক্রিকেটারদের যেন বেশি কৌতূহল সেই ভুলটা নিয়ে মানুষ কী বলছে, সংবাদমাধ্যম কী লিখছে, ফেসবুকে কী আলোচনা হচ্ছে। তাতে খেলাটা থেকেই মনোযোগ যায় হারিয়ে। সমালোচনার পাল্টা–সমালোচনা হয় দলের অন্দরমহলে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে। তারাও এই বোধ নিয়েই বড় হচ্ছেন যে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা সব জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। এমনকি সমর্থকদের শুভেচ্ছা জানানোর বিনিময়ে তাঁদের দিকে একটু তাকাতেও কারও কারও কৃপণতা বিস্ময়কর!

তবে এ অভিযোগে সব ক্রিকেটারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে না। ব্যতিক্রম তো আছেই, যাঁরা সমালোচনা থেকেও অনুপ্রাণিত হওয়ার রসদ খুঁজে নেন। তাঁরা জানেন, বাংলাদেশে ক্রিকেট একটা ভালোবাসার নাম। সে ভালোবাসায় অভিমান যেমন থাকবে, থাকতে হবে অভিমান ভাঙানো অনুতাপও।