মাটিতেই পা রাখছেন বিশ্বজয়ী ক্রিকেটাররা

বিসিবি সভাপতি বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব–১৯ দলকে নিয়ে আগামী দুই বছরের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন কাল। ছবি: প্রথম আলো
বিসিবি সভাপতি বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব–১৯ দলকে নিয়ে আগামী দুই বছরের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন কাল। ছবি: প্রথম আলো
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ বিজয়ী সম্ভাবনাময় ক্রিকেটাররা যেন হারিয়ে না যান, সে উদ্যোগ নেবে বিসিবি। দেশে ফিরে সংবর্ধনার মধ্যেও ক্রিকেটাররা জানিয়েছেন, তাঁরাও পা মাটিতেই রাখছেন।


এটা বিশ্বকাপ জয়-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনই তো, নাকি! 

এই যে বিমানবন্দর থেকে উৎসবের রেণু ওড়াতে ওড়াতে মোটর শোভাযাত্রাসহকারে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আসা, স্টেডিয়াম চত্বরে হাজারো জনতার ভিড় আর রং খেলা, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলা, লালগালিচা সংবর্ধনায় মাঠে ঢুকে খেলোয়াড়দের মিষ্টিমুখ, ট্রফি নিয়ে উল্লাস—এমন একটা উৎসবের আবহের মধ্যে কিনা শোনা গেল শাসনের বার্তাও!


শাসনের তো আসলে নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই বদলে যাওয়ার বার্তা। কাল সন্ধ্যায় মিরপুরে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে আকবর আলীর দলের বিশ্বজয় নিয়ে যতটা না উচ্ছ্বাস ছিল, বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান থেকে শুরু করে উপস্থিত সাংবাদিক—সবার মধ্যেই তার চেয়ে বেশি ছিল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের ক্রিকেটারদের ভবিষ্যতের চিন্তা। পা’টা মাটিতেই রেখে আরও ওপরে ওঠার সিঁড়ি তাঁরা ভাঙতে পারবেন কি না, সেই আলোচনা।


অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বিশ্বকাপ না জিতলেও যুবাদের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেসব দলের কয়জন ক্রিকেটার নিজেদের ধরে রাখতে পেরেছেন! এ কারণেই সংবাদ সম্মেলনে বারবার এল প্রসঙ্গটা। এই ক্রিকেটারদের ধরে রাখতে কী করবে বিসিবি? ক্রিকেটাররাও কি পারবেন যশ-খ্যাতির স্রোতে নিজ নিজ হালটা ধরে রাখতে?


কাল পর্যন্ত লক্ষণ কিন্তু আশা-জাগানিয়া। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান জানালেন আকবর আলীর দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে তাঁদের আগামী দুই বছরের পরিকল্পনার কথা। এই দুই বছর ক্রিকেটারদের প্রত্যেককে বোর্ড মাসে ১ লাখ টাকা করে ভাতা প্রদান করবে। বিশেষ অনুশীলনের মধ্যে রেখে তাঁদের অনূর্ধ্ব-২১ দল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। দলটা দেশে-বিদেশে খেলবে। বিসিবির চিন্তায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ছাপ। ক্রিকেটারদের একবারে পুরস্কারের স্রোতে না ভাসিয়ে দিয়ে এগোনো হবে তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে।


যুবাদের বিশ্বজয়কে বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মন্তব্য করেছেন নাজমুল হাসান। তাঁদের ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। জানালেন, এ জন্য বিসিবির থাকবে ‘আনলিমিটেড ফান্ড’।


কিন্তু খেলা-অনুশীলনের বাইরেও তো খেলোয়াড়দের জীবন আছে। এই বয়সে বিশ্বজয়ের খ্যাতি, পা’টা যদি এখন আর মাটিতে না পড়ে তাঁদের! স্মিত হেসে বিসিবি সভাপতির কঠিন হুঁশিয়ারি, ‘আমি ওদের বলেছি, তোমাদের সুপারস্টার হওয়ার চিন্তা করতে হবে না। ভুলেও যেন এটা মাথায় না আসে।’ পরে আরেক প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তোমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এখন থেকে সবার চোখ তোমাদের ওপর থাকবে। তার মানে বিসিবির চোখও থাকবে। তোমরা এমন কিছু করো না, যাতে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যায়।’


বোর্ড সভাপতির প্রতিটি কথায় তাঁর পাশে বসে সম্মতিসূচক মাথা দোলাচ্ছিলেন অধিনায়ক আকবর আলী। বিসিবি যে তাঁদের নিয়ে দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করেছে, সে জন্য বোর্ডকে ধন্যবাদ দিয়েছেন তিনি, ‘বোর্ড আগেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছে। সে জন্য তাদের ধন্যবাদ। বোর্ড যেভাবে পরিকল্পনা সাজাবে, আমরা সেভাবেই এগোব। এই দুই বছরে আমরা চেষ্টা করব জাতীয় দলের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমিয়ে আনতে।’


আকবর আশ্বস্ত করেছেন, বিশ্বকাপ জিতলেও তাঁদের পা মাটিতেই আছে। কাল দেশে আসার পর যেমন বিসিবি সভাপতির নেতৃত্বে বোর্ড তাঁদের সেই দিকনির্দেশনা দিয়েছে, একই পরামর্শ তাঁরা পেয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকেও। আকবর বলছিলেন, ‘ফাইনালে জেতার পর টিম ম্যানেজমেন্ট আমাদের বলেছে, এখানেই শেষ নয়। কীভাবে ভবিষ্যতে আরও ভালো করা যায়, সে পরামর্শ দিয়েছে। পরবর্তী ধাপের জন্য তৈরি হতে বলেছে। আমরাও মনে করি, আমাদের আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমাদের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়।’


শেষ তো নয়ই, আকবর বরং মনে করছেন, এটাই শুরু। তাঁদের অর্জন দেশের ক্রিকেটে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা এনে দেবে, ‘সাকিব ভাই, তামিম ভাই, মুশফিক ভাইরা আমাদের দেশের ক্রিকেটকে ভালো একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই সাফল্য আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করবে।’
বিশ্বকাপজয়ী দল দেশে ফিরছে। এ নিয়ে দেশের ক্রিকেটামোদীদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ থাকবে, সেটা আকবরও জানতেন। কিন্তু কাল বিমানবন্দর থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত যে দৃশ্যের অবতারণা হলো, সেটির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না অধিনায়কও, ‘জানতাম, মানুষ আমাদের অভিনন্দন জানাতে আসবে। তবে এতটা আশা করিনি। এটা অসাধারণ!’


আকবরদের বিশ্বকাপ জয়ও অসাধারণ এক কীর্তি। অসাধারণত্বকে বরণ করে নিতে অসাধারণ কিছু হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তবে সব অসাধারণকে ছাপিয়ে বড় অসাধারণ বোধ হয় এটিই—বিশ্বকাপ জয়ের পরও পা’টা মাটিতেই আছে আকবরদের। পরীক্ষায় ভালো ফল করা ‘সন্তান’কে নিয়ে আদিখ্যেতা নেই তাঁদের অভিভাবক বিসিবিরও।