মাশরাফির বিকল্প কারা?

মাশরাফিকে নিয়ে কানাঘুষাটা চলছিল অনেক দিন থেকেই।ছবি : প্রথম আলো

১৯ বছর ধরে খেলছেন বাংলাদেশ দলে। ঝুলিতে ২৭০ ওয়ানডে উইকেট। এক সমুদ্র অভিজ্ঞতা। কেবল পারফরম্যান্সের বিচারেই মাশরাফি বিন মুর্তজার ধারেকাছে নেই কোনো বাংলাদেশি পেসার। কিন্তু মাশরাফিকে পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করা যাবে কি! নেতা মাশরাফিও তো নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া কেউ! দুটি বিশ্বকাপে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসাধারণ প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। দলে তাঁর উপস্থিতিই বিরাট ব্যাপার। বাংলাদেশ দলে তো এমনটা ছিলেনই। ঘরোয়া ক্রিকেট বা যেকোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও যে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে দলে খেলেছেন, সেটিকেই নিজের প্রেরণার জাদুতে বদলে দিয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতির অনুভবটা দীর্ঘই হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

‘অনুপস্থিতি’ শব্দটা লেখা হচ্ছে বটে, কিন্তু মাশরাফি তো এখনো খেলছেন। এ শব্দটি লিখতে হচ্ছে কারণ তাঁকে সদ্যই জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আসছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের জন্য যে ২৪ সদস্যের প্রাথমিক দল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে নেই জাতীয় দলের সাবেক এ অধিনায়ক। নির্বাচকেরা বলছেন, কঠিন একটা সিদ্ধান্তই তাঁদের জন্য এই মাশরাফিকে বাদ দেওয়া। কিন্তু সেটি করতে হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। বয়স ৩৭ হয়ে গেছে। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে মাশরাফি পৌঁছে গেছেন এমনিতেই। ২০২৩ বিশ্বকাপের আগে দলের নতুন রক্ত ঢোকাতে হবে—মাশরাফিকে তাঁরা বাদ দিয়েছেন সেসব কথা চিন্তা করেই।

মাশরাফিকে নিয়ে কানাঘুষাটা চলছিল অনেক দিন থেকেই। ব্যাপারটা ফিসফিসানি থেকে মোটামুটি বড় আওয়াজে পরিণত হয় ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় থেকেই। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বে ৯টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। মাশরাফির উইকেট মাত্র একটি। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে চোটের কারণে বেশ কিছু দিন বিরতি দিতে হয়েছিল। গত মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে খেলেছিলেন। সে সিরিজের পরপরই নিজে ঘোষণা দিয়ে ছেড়ে দেন অধিনায়কত্ব। সাধারণ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ দলে খেলার সম্ভাবনাটা ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল সে সময়ই। করোনার কারণে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পাওয়ায় মাশরাফির ভবিষ্যৎটাও নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের সুযোগ সেটিই কাল মোটামুটি করে দিলেন জাতীয় দলের নির্বাচকেরা।

করোনার কারণে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ না পাওয়ায় মাশরাফির ভবিষ্যৎটাও নির্ধারণ করা যাচ্ছিল না।
ছবি : প্রথম আলো

গত ১৯ বছরে বহুবার চোট-আঘাতে জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। কিন্তু পারফরম্যান্সের কারণে কখনোই বাদ পড়েননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে তাঁকে না নেওয়ার যুক্তি হিসেবে ‘ভবিষ্যতের কথা’ বলার অর্থই হচ্ছে, মাশরাফির বর্তমান পারফরম্যান্স নির্বাচকদের পছন্দ নয়। আর ৩৭ বছর বয়সে এমনটা হলে এটা মুখে না বললেও মাশরাফি যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিকট ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় নেই—এটা বলাই যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মাশরাফির শূন্যস্থান পূরণ কি এতই সহজ?

মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, শফিউল ইসলাম, আল আমিন হোসেন, তাসকিন আহমেদ—মাশরাফিকে বাদ দিলে এঁরাই জাতীয় ক্রিকেট দলের পেস বোলিংয়ের পুরোনো ভরসা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এঁরাই ছিলেন মাশরাফির সঙ্গী। হালে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন নিজেকে কার্যকর প্রমাণ করেছেন। নতুন এসেছেন হাসান মাহমুদ। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের শরিফুল ইসলাম। মাশরাফির বিকল্প নিয়ে আলোচনা যেহেতু, তাই টেস্টের আবু জায়েদ আর এবাদত হোসেনের আলোচনাটা এখানে করা হচ্ছে না। তালিকাটিতে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ পেসার থাকলেও মাশরাফিকে কখনোই ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।

আছেন তাসকিনও।
ছবি : প্রথম আলো

মাশরাফি না থাকলে বড় দায়িত্বটা এখন নেবেন কে? বিশ্বকাপের পর শফিউল ইসলাম দলে ফিরে সে দায়িত্ব কিছুটা হলেও পালন করেছেন। শফিউলের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগতে পারে। পাওয়ার প্লেতে উইকেট দিয়েছেন দলকে। ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি—প্রায় প্রতি ম্যাচেই শফিউল নতুন বলে উইকেট দিয়েছেন। তবে দুর্ভাগ্য, চোটের কারণে শফিউলও নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দলে। মোস্তাফিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সফল, তাঁকেও দায়িত্ব নিতে হবে। এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনিই সবচেয়ে কার্যকর পেসার বাংলাদেশের। যদিও তিনি মাঝের ওভার, আর শেষের দিকেই ভালো বোলিং করেন। রুবেল হোসেন অভিজ্ঞ হলেও মাঝের অনেকটা সময় তিনি নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। সম্প্রতি করোনার বিরতি কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে তাঁকে বেশ ক্ষুরধার লেগেছে। নতুন বলে বেশ কিছু দারুণ স্পেল উপহার দিয়েছেন শেষ দুই ঘরোয়া টুর্নামেন্টে। তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকারদের মতো দেশের সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন লেংথ থেকে ভেতরে আসা বলে।

তাসকিনের অবস্থাও একই। তিনিও মাঝের একটা বড় সময় নিজেকে নিয়ে লড়েছেন। তিনিও সাম্প্রতিক কালে ভালো করছেন। তবে মাশরাফির বিকল্প হওয়ার দৌড়ে অন্তত নতুন বলে নিজেকে যে সাইফউদ্দিন ভালোই এগিয়ে রেখেছেন, সেটা বলে দেয় তাঁর পরিসংখ্যানই।

মাশরাফি না থাকলে বড় দায়িত্বটা যে মোস্তাফিজকেই নিতে হবে, সেটি আর না বললেও চলছে।
ছবি : প্রথম আলো

আল আমিন হোসেন অভিজ্ঞ। তিনিও বিরতি দিয়ে দলে ফিরে মোটামুটি ভালো করছেন। মোস্তাফিজের মতোই আল আমিন সবচেয়ে কার্যকর মাঝ থেকে শেষের ওভারে। তবে বাংলাদেশ দলে মাশরাফি–পরবর্তী সময়ে নতুন বলের সমাধান সেভাবে কেউই নন। বাংলাদেশের সমস্যা এটিই।

একদম নতুনদের মধ্যে আছেন বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম ও হাসান মাহমুদ। শরিফুল বাঁহাতি। এটিই শরিফুলের বাড়তি সুবিধা। অ্যাঙ্গেলের কারণে যেকোনো বাঁহাতি বোলারই সাদা বলে বেশ কার্যকর। যদি তাঁর ইনসুইং থাকে, তাহলে তো কোথাই নেই। এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে শরিফুলকে সুইং করাতে দেখা না গেলেও নতুন বলে ভালোই করেছেন বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে। গতি ও বাউন্সের সঙ্গে আগ্রাসী মনোভাব শরিফুলের মূল শক্তি।

গতি ও বাউন্সের সঙ্গে আগ্রাসী মনোভাব শরিফুলের মূল শক্তি।
ছবি : প্রথম আলো

হাসানকে ধরা হয় বাংলাদেশ পেস বোলিংয়ের ভবিষ্যৎ। পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসন হাসানের দক্ষতার ভক্ত। পরিষ্কার অ্যাকশন, গতি, সিম পজিশন—সবই হাসানকে আলাদা করে। সাদা বলে ক্রিকেটে পাওয়ার প্লে, মিডল ওভার ও ডেথ ওভার—তিন অবস্থার বোলার হতে পারেন তিনিও। দেশের হয়ে মাত্র একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা হয়েছে হাসানের। আরও সুযোগ পেলে কেমন করেন, সেটিই দেখার বিষয়।

মাশরাফির বিকল্প খুব শিগগির খুঁজে পাবে বাংলাদেশ—এটা কিন্তু বলা যাচ্ছে না!