মুমিনুলের ‘আবিষ্কার’ সত্যিই ভ্রু কুঁচকে দেয়

পাল্লেকেলে টেস্টে হারের পর সংবাদমাধ্যমের সামনে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হক।ছবি: টুইটার

উপমহাদেশের উইকেটে টেস্ট ম্যাচে ব্যাট-বলের লড়াই শুরুর আগেই একটি বিষয় মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মুদ্রানিক্ষেপে ভাগ্য পরীক্ষা—কে আগে ব্যাটিং করবে?

এই প্রশ্নের সমাধান মিলে যাওয়ার পর নাকি ম্যাচের ভাগ্য শতকরা ৫০ শতাংশ সময় নির্ধারিত হয়ে যায়! হ্যাঁ, তর্কের জায়গা তো আছেই। কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে দেশের অধিনায়ক যদি নির্দিষ্ট একটি ম্যাচ প্রসঙ্গে এ কথা বলেন, তাহলে গুরুত্ব না দিয়ে উপায়ও নেই।

কথা হচ্ছে পাল্লেকেলেতে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট নিয়ে। আজ টেস্টের পঞ্চম ও শেষ দিনে শ্রীলঙ্কার কাছে ২০৯ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। টস জিতে শ্রীলঙ্কা আগে ব্যাট করেছে। আজ হারের পর তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদমাধ্যমকে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুমিনুল হকের বলা দুটি কথা নজর কাড়তে পারে, ‘আমার মতে এই টেস্টে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল টস, অন্তত আমার চোখে।...টসেই টেস্টের ভাগ্য প্রায় ৫০ শতাংশ ঠিক হয়ে যায়।’

মুমিনুলের কথা অনুযায়ী, বাংলাদেশ টস হারের পরই ম্যাচের ভাগ্য অর্ধেক ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বাকি অর্ধেক ঠিক হয়েছে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে—এই ‘যৌথ প্রযোজনা’তেই দলের বড় হার।

কী আশ্চর্য, যে খেলা ব্যাট ও বলের, যে খেলা মানসিক ও শরীরী কৌশলের, সেখানে উইকেট গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হলেও এত দিন সব দল চেষ্টা করেছে, ব্যক্তিগত ও দলীয় দক্ষতার সংমিশ্রণে উইকেটের বিরূপ আচরণ সহ্য করে জয় ছিনিয়ে আনতে। সেখানে টস নিয়ে মুমিনুলের এই ‘আবিষ্কার’ সত্যিই ভ্রু কুঁচকে দেয়।

কেননা, খেলা শুরুর আগেই টস যদি ম্যাচের ভাগ্য ‘অর্ধেক’ গড়ে দেয় তাহলে এই বিভাগ নিয়ে প্রতিটি দলের না হলেও অন্তত বাংলাদেশ দলের আলাদা করে অনুশীলনের প্রস্তুতি থাকা উচিত। প্রতিটি টুর্নামেন্টের আগে খেলোয়াড়েরা যেমন প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন, তেমনি অধিনায়কেরও মুদ্রানিক্ষেপে আলাদা করে ঘাম ঝরানো এখন সময়ের দাবি। হাসির কিছু নেই।

উপমহাদেশের উইকেটে টস তো সত্যি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ম্যাচ হারের পর পারফরম্যান্সের চেয়ে টস হার-ই তো মুখ্য হয়ে ওঠে!

টস কেন মুখ্য সেটাও অজানা নয়। উপমহাদেশের মাটিতে টেস্ট মানে অন্তত উইকেট নিয়ে একটি ধারণা বেশির ভাগ সময় ঠিক হয়—ম্যাচের অন্তত প্রথম দুই দিন ব্যাটিংবান্ধব। এরপর স্পিন ধরতে শুরু করে উইকেটে।

দিন গড়িয়ে চলার সঙ্গে স্পিন উইকেটের কামড়ের জোরও বাড়তে থাকে। এমন নয় যে এই তথ্য কেউ জানেন না। টেস্ট খেলুড়ে দেশের অধিনায়ক থেকে এসব আমজনতার জানা কথা। আর এবার শ্রীলঙ্কা সফরে উইকেট নিয়ে তো এমনিতেই প্রচুর কথা হয়েছে। পাল্লেকেলেতেই প্রথম টেস্টে উইকেট ছিল একদম নিষ্প্রাণ। ম্যাড়মেড়ে ড্র করেছিল দুই দল। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায়, দ্বিতীয় টেস্টের উইকেট হবে উপমহাদেশের প্রথাগত—এমনকি ম্যাচের আগের শেষ সংবাদ সম্মেলনেও শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক দিমুথ করুণারত্নে বলেছিলেন, ‘শেষ তিন দিনে উইকেটে বাঁক থাকবে।’

লঙ্কান স্পিনের সামনে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ দল।
ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কা তাই আগের টেস্টে দুই স্পিনার-তত্ত্ব থেকে সরে এসে তিন স্পিনার নিয়েছে দ্বিতীয় টেস্টে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে গেছে দুই স্পিনার-তত্ত্বেই। ওদিকে পেসার তিনজন। উইকেটের আচরণ কেমন হবে তা যখন জানা, তখন পরিস্থিতি বুঝে সামাল দিতেই তো দল গড়া হয়, নাকি?

অবশ্য টসকে মূল উপজীব্য করে নিছক একাদশ বানানোর জন্য একাদশ গড়লে সেটা আলাদা কথা! চাইলে এখানে বিধিলিপির দোষও দেওয়া যায়। প্রতি ম্যাচে টস তো আর দুজন জেতে না, একজন-ই জিতে থাকেন।

মুমিনুলের দুর্ভাগ্য, এ বেলা পয়সা ছুড়ে ভাগ্য পরীক্ষায় জিতেছেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক।
মুমিনুলের কাঁধে তাই দোষ চাপানো যায় না। যদিও টস হারে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে দলে ১১ জন খেলোয়াড় থাকেন।

টেস্ট ক্রিকেটে ১৪৪ বছরের ইতিহাসে শোনা গেছে, খেলোয়াড়দের দক্ষতার ভিত্তিতেই ম্যাচের ফল নির্ধারিত হয়। উইকেট তো ‘পরীক্ষাকেন্দ্র’—সেখানে আগে কিংবা পরে যখন, যে পরিস্থিতিতেই ব্যাটিং-বোলিং করা হোক না কেন, তা উতরে যেতেই তো অনুশীলনের পর অনুশীলন।

লঙ্কান স্পিনারদের বাঁক সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন ব্যাটসম্যানরা।
ছবি: এএফপি

প্রথম দুই দিন ব্যাটসম্যানদের থাকবে তা জানা কথা, শেষ তিন দিন স্পিনারদের সেটাও জানা কথাই। আবার জানা এবং চিরচেনা দৃশ্যও দেখা গেল মাঠে, উইকেটে স্পিন ধরা মাত্রই হাঁটু কাঁপাকাঁপির শুরু। ইতিবাচক ক্রিকেট খেলার অজুহাতে—আসলে রক্ষণাত্মক খেলার ধৈর্য হারিয়ে—তুলে মারা থেকে মুশফিকুর রহিমের অসহায় আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মনে করে দেখুন, একটা প্রশ্ন মাথায় ঘাই মারবেই—দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে এত এত স্পিনবান্ধব উইকেট তাহলে কিসের জন্য?

শ্রীলঙ্কা প্রথম দুই দিন ব্যাট করেছে। পরের তিন দিন মিলিয়ে বাংলাদেশ দুবার ব্যাটিংয়ে নেমেছে। প্রথম ইনিংসে ২৫১ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ২২৭ রানে অলআউট।

মুমিনুল বলেছেন, ‘আমরা এই টেস্ট হেরেছি প্রথম ইনিংসেই, যখন ২৫০ (আসলে ২৫১) রানে অলআউট হয়ে যাই। আমাদের আরও ভালো ব্যাট করা উচিত ছিল।’ সে তো বটেই। টেস্ট মর্যাদাপ্রাপ্তির ২১ বছর পেরিয়ে ঘরে ব্যাটিং ও স্পিনবান্ধব উইকেটের বাগিচা বিছিয়ে বানানো ‘(বদ)অভ্যাস’ও কিন্তু মুমিনুলের এ কথায় ডুকরে কেঁদে উঠবে।

মুশফিকুর রহিমও সুবিধা করে উঠতে পারেননি স্পিনে।
ছবি: এএফপি

কেননা, বিদেশের মাটিতে স্পিনবান্ধব উইকেটে গিয়ে যদি খাবি-ই খেতে হয় তাহলে ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত স্পিনবান্ধব উইকেটের কি হেতু?

একটাই হেতু। ক্রিকেটের সব-ই আসলে আনুষ্ঠানিকতা। এই যে সাদা পোশাক, লাল বল, ছ-খানা স্টাম্প...সাইফ হাসানের উড়িয়ে মেরে আউট হওয়া, উঠে আসা বলে টেকনিক্যালি বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানের অসহায়ের মতো ক্যাচ দেওয়া আর বাকিদের স্পিন খেলতে গিয়ে নাচার অবস্থা—এ সবই স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা।

আসল বিষয় হলো টস। টস জিতলেন তো অর্ধেক ম্যাচ জিতলেন। টস হারলেন তো দক্ষতাও কিছু করতে পারে না!