মেসি-নেইমার সোনা জিতেছেন, অলিম্পিকে রোনালদো কী করেছেন?

অলিম্পিক সোনার স্বাদ পেয়েছেন তারাছবি: টুইটার

দ্বৈরথটা লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরই। এক যুগের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘দ্বি–চ্ছত্র’ আধিপত্য দেখিয়েছেন দুজন, মাঝে টানা ১০ বছরে তাঁদের দাপটে ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ব্যালন ডি’অরের মঞ্চ রাঙানো হয়নি আর কারও।

তাঁদের সঙ্গে আর কারও নাম বলতে গেলে সেই নামটা নেইমারই হবে! এখনো ব্যালন ডি’অর জেতা হয়নি ঠিকই, মেসি-রোনালদোর মতো করে ফুটবলের নিয়ন্ত্রণটা এই ২৯ বছর বয়সে এসেও সেভাবে নেওয়া হয়নি ব্রাজিল তারকার, কিন্তু দক্ষতায় আর নামে মেসি-রোনালদোর চেয়ে নেইমারকে পিছিয়ে রাখবেন না খুব বেশি মানুষ। সে কারণেই কিনা, মেসি-রোনালদোর তুলনায় নেইমারও অবধারিতভাবেই চলে আসেন।

তা অলিম্পিকে যখন পুরো বিশ্ব বুঁদ, অলিম্পিকের তুলনাই-বা কেন আর বাদ থাকে! সেখানে অবশ্য মেসি আর নেইমারের অর্জন একেবারে চোখের সামনে। মেসি দেশকে অলিম্পিকের ফুটবলে সোনার পদক এনে দিয়েছেন, নেইমারও তা-ই। কিন্তু রোনালদো অলিম্পিকে কী করেছেন?

অলিম্পিকের সাফল্যে মেসি-নেইমারের পাশে নেই রোনালদো
ফাইল ছবি

অলিম্পিকে রোনালদোর অর্জন কিংবা হতাশা নিয়ে আলোচনা এত কম হয় যে রোনালদো কখনো অলিম্পিকে খেলেছেন কি না—এ প্রশ্নই হুট করে করলে হয়তো অনেকে তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে অলিম্পিকে রোনালদো কী করেছেন, তা তো একনিশ্বাসে বলে দিতে পারা মানুষের সংখ্যা হাতে গোনাই হবে!
পর্তুগিজ যুবরাজ দেশকে অলিম্পিকে সোনা এনে দিতে যে পারেননি, সে তো সবারই জানা। এ পর্যন্ত পর্তুগাল অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পেরেছে মাত্র চারবার, এর মধ্যে সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৯৬ অলিম্পিকে সেমিফাইনাল খেলা।

এ দিকটাতে অবশ্য মেসি আর নেইমারের সঙ্গে রোনালদোর তুলনাই চলে না। মেসি ২০০৮ অলিম্পিকে আর্জেন্টিনাকে সোনা জিতিয়েছেন, অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার টানা দ্বিতীয় সোনা ছিল সেটি। দেশকে অলিম্পিক সোনা এনে দেওয়ার পথে টুর্নামেন্টে ২ গোল করেছেন মেসি—এর মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে গোলটি তো টুর্নামেন্টের সেরা গোল হওয়ার দাবিদার! মেসি গোল করিয়েছেন আরও ৩টি, যার একটি ছিল ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে সোনা এনে দেওয়া একমাত্র গোল। হুয়ান রোমান রিকেলমের পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন মেসি।

চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে ফাইনালে গিয়েও সোনা না জেতার আক্ষেপ এতটাই পোড়াচ্ছিল নেইমারকে যে অলিম্পিকে খেলার জন্য কোপা আমেরিকার দল থেকে নাম তুলে নেন নেইমার।

ক্যারিয়ারে ওই একটি অলিম্পিকেই খেলেছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। ২০১৬ রিও অলিম্পিকেও খেলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে চোখ রেখে সে সময়ের আর্জেন্টিনা কোচ জেরার্দো মার্তিনো অলিম্পিকের দলে মেসিকে না রাখার সিদ্ধান্ত নেন।

নেইমারের মঞ্চ ছিল ২০১৬ রিও অলিম্পিক। চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে ফাইনালে গিয়েও দেশকে সোনা জেতাতে না পারার আক্ষেপ এতটাই পোড়াচ্ছিল নেইমারকে যে ঘরের মাটির অলিম্পিকে খেলার জন্য সেবারের কোপা আমেরিকার দল থেকে নিজের নাম তুলে নেন নেইমার। বার্সেলোনা তাঁকে শর্ত দিয়ে রেখেছিল দুটি টুর্নামেন্টের যেকোনো একটি ছাড় দিতে হবে, নেইমার ছেড়ে দিয়েছিলেন কোপা আমেরিকাকেই! সে সময়ের ব্রাজিল কোচ দুঙ্গা আর ক্লাব বার্সেলোনার সঙ্গে সেভাবেই বোঝাপড়া করে রেখেছিলেন। ইচ্ছেপূরণও হলো নেইমারের। গাব্রিয়েল জেসুস, গাব্রিয়েল বারবোসা আর নেইমার মিলে তিতের অধীন ব্রাজিল দলে আলো ছড়ালেন, মুগ্ধতা ছড়িয়ে ব্রাজিলকে এনে দিলেন দেশটির ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক সোনা। টুর্নামেন্টে ৪ গোল করেছেন নেইমার, করিয়েছেন ১টি।

আগুয়েরোর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুটা তো এখানেই
ছবি: টুইটার

সে তুলনায় রোনালদোর অলিম্পিক রেকর্ড অন্ধকারে ঢাকা। ক্যারিয়ারে এ নিয়ে একবারই অলিম্পিকে খেলেছেন রোনালদো, ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিক। সে সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলা রোনালদোকে তাঁর ক্লাব যে ২০০৪ ইউরোর পর অলিম্পিকেই খেলতে অনুমতি দিয়েছে, সেটাই কম নয়!

অলিম্পিক ফিফার টুর্নামেন্ট নয় বলে সেখানে খেলোয়াড়দের ছাড়তে ক্লাবগুলো বাধ্য নয়। যে কারণে ২০০৮ অলিম্পিকে যেতে মেসিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইপর্বের ম্যাচ আছে বলে বার্সা মেসিকে কোনোভাবেই ছাড়বে না বলে ঘোষণা করে দিয়েছিল। পরে মেসির আগ্রহ দেখে সে সময়ে মাত্রই বার্সেলোনার কোচের দায়িত্ব পাওয়া পেপ গার্দিওলা ক্লাবের কর্তাদের বুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন। নেইমারের ক্ষেত্রেও বার্সেলোনা তাঁকে অলিম্পিক বা কোপা আমেরিকার কোনো একটি বেছে নিতে বলেছিল। দুটি টুর্নামেন্টই ক্লাব মৌসুমের বিরতির সময়ে বলে দুটিতেই খেললে নেইমার ক্লান্ত থাকবেন—এ-ই ছিল বার্সার যুক্তি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তবু সে সময়ের ১৯ বছর বয়সী রোনালদোকে ছেড়েছে।

নেইমারের সোনার হাসি
ছবি: টুইটার

সুযোগটা অবশ্য কাজে লাগাতে চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন রোনালদো! সেবারের পর্তুগালের অলিম্পিক দলে ছিলেন রাউল মেইরেলেস (পরে লিভারপুল-চেলসিতে খেলেছেন), তিয়াগো মেন্দেস (সে বছরই বেনফিকা ছেড়ে চেলসিতে গিয়েছিলেন), হেল্দার পোস্তিগা (সে সময়ের পর্তুগালের সিনিয়র দলের মূল স্ট্রাইকার), ব্রুনো আলভেজ (পর্তুগালের ২০১৬ ইউরোজয়ী দলে ছিলেন), জোসে বসিঙ্গোয়ার (চেলসির ২০১২ চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলে ছিলেন) মতো তারকা।

কিন্তু এমন তারকাবহুল দল নিয়ে গিয়েও অলিম্পিকে চরম ব্যর্থ পর্তুগাল। ইরাক, মরক্কো আর কোস্টারিকা ছিল গ্রুপে, এমন গ্রুপে পর্তুগাল হলো চতুর্থ! তিন ম্যাচের মধ্যে দুটিই হেরেছে, জিতেছে অন্যটি। টুর্নামেন্টে রোনালদোও দ্বিতীয় ম্যাচে মরক্কোর বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়ের পথে একটা গোল ছাড়া কিছু করতে পারেননি।

সিনিয়র দলে মেসি-নেইমার-রোনালদোর অর্জনে নেইমার এখনো পিছিয়ে আছেন বটে। তবে প্রশ্ন যখন অলিম্পিক, সেখানে মেসি-নেইমারের সামনে ম্লান রোনালদো।

মেসি, রোনালদো, নেইমার তিনজনের জন্যই বিশ্বকাপ এখনো আক্ষেপের নাম হয়ে আছে। মেসি একবার ফাইনালে খেলেছেন, নেইমারের ব্রাজিল সেমিফাইনালে উঠলেও নেইমার সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে ভয়ংকর ট্যাকলের শিকার হয়ে চোটে পড়েছিলেন। রোনালদোর বিশ্বকাপে সাফল্য বলতে ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা।

মহাদেশীয় সাফল্যে আবার নেইমার পিছিয়ে। রোনালদো ২০১৬ ইউরোতে পর্তুগালকে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা এনে দিয়েছেন, মেসি কদিন আগে আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপার আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন কোপা আমেরিকা জিতে। ব্রাজিল ২০১৯ কোপা আমেরিকা জিতলেও সে দলে নেইমার ছিলেন না, আর এবার ফাইনালে মেসির আর্জেন্টিনা নেইমারের ব্রাজিলকেই হারিয়ে শিরোপা জিতেছে।

নেইমার অবশ্য ব্রাজিলের জার্সিতে একেবারে শিরোপাশূন্য নন। তবে সে শিরোপাটি ছিল ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপ, যে টুর্নামেন্ট দুই বছর আগে বাতিল করে দিয়েছে ফিফা। রোনালদো ইউরোর বাইরে উয়েফা নেশনস লিগও জিতেছেন, কিন্তু সেই টুর্নামেন্টও মূলত এসেছে অর্থহীন প্রীতি ম্যাচগুলোর বিকল্প হিসেবে।

সে হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সিনিয়র দলে মেসি-নেইমার-রোনালদোর অর্জনে নেইমার এখনো পিছিয়ে আছেন বটে। তবে প্রশ্ন যখন অলিম্পিক, সেখানে মেসি-নেইমারের সামনে ম্লান রোনালদো।