যে কীর্তির জন্য ১৮ বছর পরও অভিনন্দন পাচ্ছেন অলক

যে রেকর্ড অলকের থেকে যাবে আজীবনছবি: আইসিসি

ফ্রেড স্পফোর্থ থেকে কেশভ মহারাজ।

১৮৭৯ থেকে ২০২১ সাল।

ইতিহাসের তৃতীয় টেস্ট থেকে ২৪২৬তম টেস্ট।

‘ডেভিল’ বা ‘শয়তান’ নামে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ান পেসার স্পফোর্থ টেস্ট ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন ১৮৭৯ সালে, ইতিহাসের তৃতীয় টেস্টে। ২৪২৬তম টেস্টে এসে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ হ্যাটট্রিকটি করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনার মহারাজ। স্পফোর্থ থেকে মহারাজ—সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেট হ্যাটট্রিক দেখেছে ৪৬টি। এর দুটিতে মিশে আছে বাংলাদেশি বোলারের নাম।

বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের তৃতীয় বছরেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন অলক কাপালি।
ফাইল ছবি

একজন অলক কাপালি, আরেকজন সোহাগ গাজী। তবে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিকটা করেছিলেন অলকই এবং সেটি আজকের এই দিনে। ২০০৩ সালের এই দিনে পেশোয়ার টেস্টের প্রথম ইনিংসে অলক প্রথমবার বোলিংয়ে এসেছিলেন ৭৮তম ওভারে। ৩ রান দিয়েছিলেন। সে স্পেলে ওই এক ওভারই করেছিলেন এ লেগস্পিনার।

এরপর আবারও বোলিংয়ে আসেন ১০৭তম ওভারে। মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে শাব্বির আহমেদের ৮ম উইকেট জুটিতে পাকিস্তানের ইনিংসে তখন পর্যন্ত উঠেছে ২৪ রান।
শাব্বির অলককে তুলে মারতে গিয়ে মিড–অফে ধরা পড়েন মাশরাফি বিন মুর্তজার হাতে। পরের বলে দানিশ কানেরিয়া অফস্টাম্পের বাইরের বলটা ছেড়ে দিয়ে এলবিডব্লু। ২ ওভার, ১ মেডেন, ২ উইকেট—ওই সময়ে অলকের বোলিং ফিগারটা দাঁড়াল এ রকম।

মোহাম্মদ রফিকের পরের ওভারের প্রথম বলেই ছয় মারলেন ইউসুফ, তাঁর হাতে তো তখন সময় নেই বেশি। তবে পরের ওভারের জন্য স্ট্রাইক রাখতে পারলেন না। অলক এসে করলেন ফ্লিপার। মিস করে গেলেন উমর গুল। অলক পেয়ে গেলেন হ্যাটট্রিক। শুধু টেস্ট নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিক সেটা।

২০০৩ সালে পেশোয়ারে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিকের ১৮ বছর পূর্ণ হলো আজ। সেই ঘটনার দেড় যুগ পার হয়ে গেলেও সেটি ভোলার কথা নয় অলকের। মুঠোফোন প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘এটা তো আসলে আজীবন মনে থাকার মতোই ঘটনা। আজকেও মেসেজ পেয়েছি। ভালোই লাগে, দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছিলাম। এটা তো আসলে ভোলা যায় না!’

একটা হ্যাটট্রিক এমনিতেই বিশেষ কিছু। অলকেরই কথা, ‘হ্যাটট্রিক তো সব সময়ই বিশেষ কিছু। এত দিন ধরে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, খুব বেশি খেলোয়াড় তো করতে পারেননি। বিশ্বের সেরা সেরা কত বোলারেরই হ্যাটট্রিক নেই।’ তবে কাপালির হ্যাটট্রিক ‘হ্যাটট্রিকে’র চেয়েও বিশেষ কিছু, কারণ ওটা বাংলাদেশের হয়েই কারও প্রথম হ্যাটট্রিক।

অলকের সেই হ্যাটট্রিকের মাহাত্ম্য আছে আরও। কাপালির ৩ বলে ৩ উইকেট বাংলাদেশকে এনে দিল লিড। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ৩৬১ রানের জবাবে পাকিস্তান থামে ২৯৫ রানে। ৬৬ রানের লিড বাংলাদেশের। টেস্টে তার আগে কখনো প্রথম ইনিংসে লিড নিতে পারেনি বাংলাদেশ।

অলক কাপালি, বাংলাদেশের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক তাঁর
ফাইল ছবি

পাকিস্তান অলআউট হওয়ার সময় অলকের বোলিং ফিগার ছিল ২.১-১-৩-৩। ১৮ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও অলকের ওই বোলিং আরেকটা দিক দিয়েও এখনো বাংলাদেশের রেকর্ড। তাঁর পরে সোহাগ গাজীও হ্যাটট্রিক করেছেন টেস্টে। তবে এখন পর্যন্ত টেস্টের এক ইনিংসে অলকের মতো এত কম রান দিয়ে এত উইকেট যে নিতে পারেননি আর কোনো বাংলাদেশি বোলারই! সে রেকর্ডের কথা মনে করিয়ে দিলে কাপালি হাসেন, ‘হ্যাঁ, জানি এটা। মাঝে মাঝে সেরা দশ বোলিংয়ে বা ও রকম তালিকায় দেখায়।’

অলক ব্যাখ্যা করেছেন ও রকম বোলিং ফিগারের কারণটাও, ‘সেদিন বোলিংও তো আসলে কম করেছিলাম। (মোহাম্মদ) রফিক ভাইয়ের মতো অভিজ্ঞ বোলার ছিলেন দলে। আমার ধারণা, আমাদের এখনকার সেরা বোলার সাকিবের সঙ্গে রফিক ভাইয়ের ভালো একটা লড়াই হতে পারে সেরার দৌড়ে। ওনার সময়ে তো উনিই সেরা ছিলেন। আর আমি সেদিন শুধু স্টাম্পে বোলিং করতে চেয়েছিলাম। লেজের দিকের ব্যাটসম্যান ছিল, ওরা একটু সহজ শিকারই। ওদের স্টাম্পে বোলিং করলে কাজে দেয় বেশি। ভালো জায়গায় বল করছিলাম।’

বাংলাদেশ অবশ্য ম্যাচটা জেতেনি। অলকের বোলিংয়ে বেশ ভালো একটা লিড পেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে আরেক দফা শোয়েব আকতারের তোপে পড়ে বাংলাদেশ থেমে গিয়েছিল মাত্র ৯৬ রানেই। পরে মোহাম্মদ হাফিজের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানই জিতে নিয়েছিল পেশোয়ার টেস্টটা।

তখন তো এখনকার মতো রিভিউ ছিল না, প্রযুক্তির এত ব্যবহার ছিল না। আম্পায়ারের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত পক্ষে আসতে পারত আমাদের, কিন্তু আসেনি।
অলক কাপালি

মুলতানে পরের টেস্টে প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানকে ১৭৫ রানে গুটিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল ১০৬ রানের লিড। ২৬১ রানের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬৪ রানে ৭ উইকেট হারিয়েছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশের মুঠো থেকে শেষ পর্যন্ত ইনজামাম-উল-হক একাই টেস্টটা ছিনিয়ে নেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা এক ইনিংস খেলে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে অলকের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে সেই টেস্টটাও। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথমে চোখে আঘাত পেয়ে উঠে গিয়েছিলেন ব্যাটিং থেকে। এরপর আবার ব্যাটিংয়ে নেমে আউট হয়ে যান ইয়াসির আলীর বলে কট-বিহাইন্ড হয়ে। তবে পরে টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, পাকিস্তান অধিনায়ক ও উইকেট কিপার রশীদ লতিফ ক্যাচটা তুলেছিলেন মাটি থেকে। সে ক্যাচের পর নিষিদ্ধ হয়েছিলেন লতিফ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এরপর আর ফেরা হয়নি তাঁর।

আর সবার মতোই অলকও এখনো আফসোসে পোড়েন সে ম্যাচটা নিয়ে, ‘ইনজামামই ও রকম দুর্দান্ত ব্যাটিং করে ম্যাচটা পাকিস্তানকে জিতিয়ে দিয়েছিল। রশীদ লতিফ আমার ওই বিতর্কিত ক্যাচটা নিল। তখন তো এখনকার মতো রিভিউ ছিল না, প্রযুক্তির এত ব্যবহার ছিল না। আম্পায়ারের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত পক্ষে আসতে পারত আমাদের, কিন্তু আসেনি।’ মুলতান টেস্ট সে কারণেই হয়ে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম এক আক্ষেপের নাম।

আমার কথা হচ্ছে, ফিটনেস থাকলে আমি কেন খেলব না? শোয়েব মালিককে দেখুন। বিশ্বজুড়ে খেলছে। আমরা যদি চিন্তা করি—আগেভাগেই কোচিং বা এসবে চলে আসব, তাহলে হবে না।

আক্ষেপ হতে পারে অলকের ক্যারিয়ার নিয়েও। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তাঁর আগমন ছিল আশাজাগানিয়া। তবে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি অলক। ১৭ টেস্ট, ৬৯টি ওয়ানডের সঙ্গে খেলেছেন ৭টি টি-টোয়েন্টি। তবে কোনো সংস্করণেই তাঁর ব্যাটিং গড় ২০ ছোঁয়নি।

অলকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থমকে গেছে ২০১১ সালেই। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে এই ৩৮ ছুঁই ছুঁই বয়সেও নিয়মিত তিনি। অলকের পরের লক্ষ্য সিলেট বিভাগীয় দলটাকে গোছানো, ‘খেলা ছাড়ার আগে সিলেট দলটাকে আরেকটু গুছিয়ে দিতে চাই। আমি, এনাম (এনামুল হক জুনিয়র), তান্না (ইমতিয়াজ হোসেন) ছাড়া তো তেমন সিনিয়র ক্রিকেটার নেই। এখনো জাতীয় দলে আমাদের সিলেট থেকে বেশ কয়েকজন পেসার আছে—ইবাদত হোসেন, আবু জায়েদ রাহী। তবে ব্যাটসম্যান নেই। একসময় জাতীয় দলে ৫-৬ জন ক্রিকেটার থাকত সিলেটের।’

অলকের কাছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটাই সবকিছু নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ না পেলে খেলা ছেড়ে দিতে হবে, এমনটাও মানেন না তিনি, ‘আমাদের অনেক জুনিয়র আছে, যারা অবসর নিয়েছে। কিন্তু অনেকের সিদ্ধান্তই ভুল মনে হয়েছে আমার। আমার কথা হচ্ছে, ফিটনেস থাকলে আমি কেন খেলব না? শোয়েব মালিককে দেখুন। বিশ্বজুড়ে খেলছে। আমরা যদি চিন্তা করি—আগেভাগেই কোচিং বা এসবে চলে আসব, তাহলে হবে না।’

প্রথম শ্রেণিতে ৯০০০-এর ওপর রান অলকের, সঙ্গে ২১৬টি উইকেট। পেশোয়ারে করা হ্যাটট্রিকসহ এই উইকেটগুলোর ৬টিই তিনি নিয়েছেন টেস্টে। টেস্ট ক্যারিয়ারে এত কম উইকেটের মালিক হয়েও হ্যাটট্রিক করার কীর্তি অলক ছাড়া নেই আর কারও।

অলকের অবশ্য রেকর্ড–টেকর্ডে কিছু যায় আসে না। প্রতিবছর ২৯ আগস্ট দিনটা এলেই তাঁর মুঠোফোনে বাড়তি কিছু খুদে বার্তা আসে। এখনো শুভেচ্ছা পান বাংলাদেশের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিকের কীর্তির জন্য। এর বাইরে অলকের আর কিছুই চাওয়ার নেই।