রংধনুর দেশে নতুন সূর্যোদয়

দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ—দুই সপ্তাহ আগেও এমন আশা করার সাহস দেখাত না কেউছবি: এএফপি

সেঞ্চুরিয়নে বাংলাদেশের জয়োৎসব দেখতে দেখতে ২০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের প্রথম সফরের ওই ঘটনাটা খুব মনে পড়ছিল। ইস্ট লন্ডনে প্রথম টেস্টে টসে জিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক খালেদ মাসুদ প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পরদিন দক্ষিণ আফ্রিকার এক পত্রিকায় লেখা হলো, ‘বাংলাদেশ টসে জিতেছে এবং প্রথম ব্যাটিং করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।’

কথাটা খুবই অপমানজনক, তবে খুব বেশি প্রতিবাদী হওয়ার উপায় ছিল না। খালেদ মাসুদের ওই সিদ্ধান্তের মূল কারণ তো আসলেই দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলারদের মুখোমুখি হতে ঘোরতর অনিচ্ছা। যে অনিচ্ছুক দলের তালিকায় বাংলাদেশ মোটেই নিঃসঙ্গ ছিল না।

বাউন্সে চিরকালীন দুর্বলতা ক্রিকেটের সেই আদিকাল থেকেই উপমহাদেশীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিনতম পরীক্ষার মঞ্চ বানিয়ে রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে।

২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করা সে বলের পর রুবেল
ফাইল ছবি: বিসিবি

স্লো–লো উইকেটে খেলে বেড়ে ওঠা ব্যাটসম্যানরা এই দুই দেশে ব্যাটিং করতে নেমে দেখেছেন, বল কখনো পাঁজরে ছোবল হানছে, কখনো বা মুখে। উইকেট বাঁচানোর মতোই, কখনোবা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে শারীরিক নিরাপত্তা। বাউন্সে এক–দুই ইঞ্চি পার্থক্যই যেখানে ব্যাটিংয়ের কাজটাকে অনেক কঠিন করে তোলে, সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাপারটা মোটেই এক–দুই ইঞ্চিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। এসব মনে রাখলে বাংলাদেশের এই সিরিজ জয়কে শুধু ‘ঐতিহাসিক’ বলেও যেন সেটির পুরো মহিমা বোঝানো যাচ্ছে না। তাহলে কীভাবে যায়?

কিছু তথ্য হয়তো কাজে আসবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় উপমহাদেশীয় দলগুলোর চ্যালেঞ্জের কথা বলছিলাম। যেটির প্রমাণ, সেখানে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জিততে ভারতের ২৬ বছর লেগেছে। সিরিজ খেলতে হয়েছে ৫টি। পাকিস্তানের অপেক্ষা ১১ বছরেই শেষ হলেও খেলতে হয়েছে বাংলাদেশের মতোই ৪টি সিরিজ। উপমহাদেশের অন্য দেশ শ্রীলঙ্কা তো পাঁচবারের চেষ্টাতেও জিততে পারেনি এখনো। এই বছরের শুরুতেই ভারত ৩–০তে সিরিজ হেরে এসেছে। এই তিনটি দলই যে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে, এটা মনে করিয়ে দেওয়াটাও একটু কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে।

২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার পর মাহমুদউল্লাহ
ফাইল ছবি: এএফ[ই

এর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসটাও যোগ করে নিতে বলি। এবারের আগে যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘সম্মানজনক’ পরাজয়টাও আসলে রীতিমতো অসম্মানজনক। কারণ, রানের হিসাবে তা ৬৮, উইকেটের হিসাবে ৭। এক শ রানের বেশি ব্যবধানে চারটি হার আছে, একটা তো ২০০ রানেও, ১০ উইকেটে ৩টি। সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়, সেটিও সিরিজ–নির্ধারক ম্যাচে ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে, অনায়াসেই যা ১০ উইকেটে হতে পারত...অভূতপূর্ব–অদৃষ্টপূর্ব তো বটেই; অবিশ্বাস্য আর অভাবনীয়ও কি নয়!

অঙ্কের কচকচানিতে একটু বিরক্ত হতেই পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের এই জয়ের মহিমা বোঝাতে যে এসব লাগে। সেই মহিমা এমনই যে, মনে এমন প্রশ্নও জাগছে—এটাই কি ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য? ২০১৫ সালে পরপর তিন সিরিজে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় তারস্বরে দাবি জানায়; দাবি জানায় ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল আর ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলার কৃতিত্বও।

কিন্তু ওই তিনটি সিরিজ জয়ই তো দেশের মাটিতে। বিশ্বকাপ আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সাফল্য মূলত একটা বড় জয়ের ওপর ভর করে। ২০১৫ বিশ্বকাপে বড় দল বলতে তো এক ইংল্যান্ডকেই হারিয়েছিল বাংলাদেশ, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডকে। এসব মনে রাখলে এর আগে অজেয় ভূমিতে এই সিরিজ জয় বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সেরা সাফল্যেরই স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

এই সিরিজের তাসকিনকে মনে রাখবেন সবাই
ছবি: এএফপি

রংধনুর দেশে এটাকে যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয় বলেন, তা অনেক দিক থেকেই নতুনত্বের দাবিদার। সিরিজ জয়ের ম্যাচের নায়ক এক পেসার, যাঁর হাতে ম্যাচ–সেরার সঙ্গে সিরিজ–সেরার ট্রফিও—তাসকিন আহমেদ যেন নতুন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। দেশের বাইরে ম্যাচ জেতানোর মতো ফাস্ট বোলার কই—এই হাহাকার ঘোচানোর কারণেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ সিরিজ।

অনেক দিন ধরেই পুনর্জন্মের যে ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন তাসকিন, সেটিরও যেন পূর্ণতা এখানে। পাঁচ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বশেষ সফরে তিন ম্যাচে ওভারপ্রতি ৮.২৫ রান খরচে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র ২টি। এবার বাংলাদেশের দুটি জয়েই তাঁর বড় ভূমিকা। আট বছর আগে স্মরণীয় অভিষেককে মনে করিয়ে দিয়ে যেটির সমাপ্তি। মাঝখানে ৪৬ ম্যাচ পর আবারও ৫ উইকেট।

তামিম ও সাকিবের উপস্থিতি জয়ের মুহূর্তের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে
ছবি: এএফপি

দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে নেওয়া তামিম ইকবালের সাক্ষাৎকারটার কথাও মনে পড়ছে। যেখানে একটা প্রশ্ন ছিল, যে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ কখনো জেতেনি, সেখানে বাস্তবসম্মত লক্ষ্যটা আসলে কী? তামিম উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা এমন কিছু করতে চাই, যা আমরা আগে কখনো করিনি। নিজে ভালো করতে চাই, দল হিসেবে ভালো করতে চাই। ভালো করা মানে জেতা, এটা তো আর বলার দরকার নেই। জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।’

আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার যখন শেষ, একটু হালকা চালেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, অধিনায়ককে এমন বলতে হয় বলে কি এমন বলেছেন, নাকি বিশ্বাস করেন বলেই? তামিম একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন না, উত্তরটা পেয়ে যাবেন।’

সেই উত্তর দেওয়াতে অধিনায়ক অগ্রণী ভূমিকাতেই থাকলেন। জয়ের মুহূর্তে উইকেটে সঙ্গী সাকিব আল হাসান, জয়সূচক রানও তাঁর ব্যাট থেকেই। প্রায় পুরো পরিবার হাসপাতালে—এই বিষম মানসিক চাপ নিয়েও সাকিব যে এই ম্যাচটা খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গেলেন, উইনিং স্ট্রোকটাকে মনে হলো সেটির পুরস্কার। যা শুধু সাহসীদের জন্যই বরাদ্দ থাকে।