রুট আর শাহ আবদুল করিম যখন একই মোহনায়

ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন রুট।
ছবি: টুইটার

শিরোনামটা দেখে একটু ধন্দেই পড়ে গেছেন! ভাবছেন, দুজন দুই জগতের তারকা—জো রুট খেলেন ক্রিকেট আর শাহ আবদুল করিম ছিলেন একজন বাউল, গানই ছিল তাঁর জীবন; তাঁরা দুজন একই মোহনায় মিলবেন কী করে!

যে জগতেরই হোন না কেন, যাঁরা সাধক, তাঁরা তো আসলে একই মোহনার। রুট ক্রিকেটের সাধনা করেন, আর বাউল শাহ আবদুল করিম ছিলেন সংগীতের সাধক। দুজন তো এক মোহনায় মিলতেই পারেন। শাহ আবদুল করিম পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন অনেক আগেই। তাঁর সঙ্গে রুট একই মোহনায় মিলেছেন চলমান গল টেস্টের তৃতীয় দিনে একটি কাজ করে।

সেই ভক্ত।
ছবি: টুইটার

ভারতের বাউলশিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য তখনো মারা যাননি। একবার তিনি আড্ডায় বসেছিলেন শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে। সেই আড্ডায় কালিকাপ্রসাদকে একটি প্রশ্ন করেছিলেন শাহ আবদুল করিম, ‘ধরো, একটি আসরে তুমি গান গাইতে গেলে। সেখানে এক হাজার শ্রোতা গান শুনতে জমায়েত হতে পারে। কিন্তু তুমি দেখলে, তোমার গান শুনতে মাত্র তিনজন শ্রোতা এসেছে। তুমি গাইতে পারবে সেখানে?’

কালিকাপ্রসাদ এর উত্তরে বলেছিলেন, ‘না, আমি গাইতে পারব না। কিছুতেই সেখানে গাইব না।’ এই কথার পিঠে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু গাইব। আমি বাউল, আমার কাজ গানে গানে বাউলের দর্শন প্রচার করা। আমি যদি আমার গানের কথা তিনটি মানুষকেও বোঝাতে পারি; ওই তিনটি মানুষকেই যদি আনন্দ দিতে পারি, সেটাই আমার সার্থকতা!’

করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে ক্রিকেটাররাও বলতে গেলে একই কাজ করছেন। ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় তাঁরা খেলে এসেছেন হাজার হাজার দর্শকের সামনে। একটা ভালো শট, একটা বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারির বিনিময়ে পেয়েছেন উচ্ছ্বসিত করতালি। ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি বা বোলারের পাঁচ উইকেটকে দর্শকেরা বরণ করে নেন কী পরম ভালোবাসায়! অথচ সেই ক্রিকেটারদেরই কিনা এখন খেলতে হচ্ছে দর্শকবিহীন মাঠে। ফুটবলারদের অবস্থাও তা-ই। কাজটা যে কতটা কঠিন, তা অনেকবারই অনেক খেলোয়াড় বলেছেন।

চলমান গল টেস্টের কথাই ধরুন, দুই দল খেলছে একজন মাত্র দর্শকের সামনে! এমনিতে দর্শকবিহীন মাঠেই খেলা হওয়ার কথা। কিন্তু প্রিয় দলের খেলা দেখতে পাগলপ্রায় এক বার্মি-আর্মি (ইংল্যান্ডের কট্টর সমর্থক) ১০ মাস ধরে অপেক্ষা করে ছিলেন। রব লুইস নামের এই সমর্থক শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন ১০ মাস আগে, ইংল্যান্ড যখন সফরে গিয়েছিল দ্বীপ দেশটিতে। কিন্তু করোনার কারণে সফর অসমাপ্ত রেখেই ফিরে যায় তারা। রব লুইস আর যাননি, তিনি অপেক্ষায় ছিলেন কবে আবার ইংল্যান্ড সফরের জন্য ফিরে আসে!

দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন রুট।
ছবি: টুইটার

লুইসকে তাই মাঠে থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুমতি দিয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বোর্ড। মাঠে থাকা একমাত্র সেই দর্শককে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা দেখিয়েই রুট মিলেছেন শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে এক মোহনায়। গল টেস্টের দ্বিতীয় দিনে গতকাল টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৮তম সেঞ্চুরি পেয়েছেন রুট, আজ সেটিকে রূপ দিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরিতে। রুটের ডাবল সেঞ্চুরিতে উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ড্রেসিংরুমে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন তাঁর সতীর্থরা। হাততালি দিয়ে ডাবল সেঞ্চুরি বরণ করে নিয়েছেন তাঁর সতীর্থ আর কোচিং স্টাফের সদস্যরা। তবে রুট সেদিকে নয়, তাঁর ব্যাট প্রথমে উঁচিয়ে ধরেছেন মাঠে থাকা একমাত্র সেই দর্শকের দিকে।

এটা তো শাহ আবদুল করিমের দর্শনের মতোই! শাহ আবদুল করিম যেমন একজনের জন্য গাইতেন, সেই একজন শ্রোতাকে সম্মান দেখাতে আর বিনোদন দিতে। রুটও একমাত্র ওই দর্শকের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিলেন—একজনের জন্যও খেলতে পারেন তিনি! রুটের এই কাজের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশংসার ঝড় উঠেছে। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানকে প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন বিশ্বজোড়া ক্রিকেটপ্রেমীরা।