রোডসের এ কেমন বিদায়

বিশ্বকাপ শেষ হতেই বিদায় দিয়ে দেওয়া হলো ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসকে। ছবি: প্রথম আলো
বিশ্বকাপ শেষ হতেই বিদায় দিয়ে দেওয়া হলো ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসকে। ছবি: প্রথম আলো
>

হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার পর যাঁরা নতুন কোচের মধ্যে ‘ভালো মানুষ’ দেখতে পেয়েছিলেন, তারাই এখন সেই ‘ভালো মানুষ’ স্টিভ রোডসকে পছন্দ করছেন না।

শেষ পর্যন্ত চলেই যেতে হচ্ছে স্টিভ রোডসকে। বিশ্বকাপ-ব্যর্থতার বোঝা তাঁর কাঁধেই যে চাপিয়েছে বিসিবি! বলির পাঁঠা হয়ে তাঁকে ছাড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব। গত বছর ৭ জুন বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন ইংলিশ কোচ রোডস। এর ঠিক এক বছর এক মাস পর বিসিবি তাঁকে জানিয়ে দিল, ‘ধন্যবাদ। আপনাকে আমাদের আর প্রয়োজন নেই।’

বিসিবি বলেছে, পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতেই নাকি এই বিচ্ছেদ। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর কথায় এটিও পরিষ্কার যে বিশ্বকাপে রোডসের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করেই তাঁরা সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। একই কথা বলেছেন বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস। তবে রোডসের কাজের কোথায় ঘাটতি ছিল, বিসিবি এখনো তা পরিষ্কার করেনি।

পারফরম্যান্স মূল্যায়নের জন্য এক বছর যথেষ্ট সময় কি না, সেটি একটি প্রশ্ন। আর এক বছর তো নয়, রোডসকে চাকরিচ্যুত করতে বিসিবি মূল্যায়ন করেছে শুধুই বিশ্বকাপে। নইলে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ দল সাফল্যই তো বেশি পেয়েছে! ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে শুরু। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এশিয়া কাপে রানার্সআপ। দেশে ফিরে পিঠাপিঠি হোম সিরিজে জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো। খারাপের মধ্যে শুধু নিউজিল্যান্ড সিরিজটাই। রোডসের সময়ে ৩০টি ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ১৭ টিতে। সঙ্গে আট টেস্টে তিন জয়। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ও আছে। রোডসের অধীনে একই দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ জিতেছে টি-টোয়েন্টিতেও।

যে বিশ্বকাপের ‘রিপোর্ট কার্ড’ সামনে রেখে বিসিবি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বেশি উৎসাহিত হলো, তাতেও বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স খুব খারাপ বলার উপায় নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে হারিয়ে টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৫ নম্বর দল ছিল বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সঙ্গে লড়াই এবং সাকিব আল হাসান ও মোস্তাফিজুর রহমানের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও থাকবে অর্জনের খাতায়। প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের সমীহ পেয়েছে। বলতে পারেন এসবে কোচের ভূমিকা কোথায়? আসলে কোচদের ভূমিকাই এ রকম থাকে যে, সেটি সব সময় দেখা যায় না। বোঝার ক্ষমতা থাকলে ফলাফল দেখেই বুঝে নেওয়া যায়।

শুধু বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করেই রোডসকে বিদায় করা হচ্ছে, সেটিও বিশ্বাস করা কঠিন। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে টুর্নমেন্টে বাংলাদেশ দল যখন খুব ভালো অবস্থানে, বিশ্বকাপের পর রোডসকে বিদায় করে দেওয়ার আলোচনা শোনা যাচ্ছিল তার আগে থেকেই। বলতে পারেন বিসিবি শুধু বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচের পর কোচ বিদায়ের সিদ্ধান্ত কিছুদিনের জন্য স্থগিত বলেই জানা গিয়েছিল। সে রাতে লন্ডনের এক হোটেলে কোচিং স্টাফদের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে বিসিবির কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে সভা করেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। হুট করে নতুন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে সভায় নতুন ‘লাইফ লাইন’ দেওয়া হয় রোডসকে। সিদ্ধান্ত হয় অন্তত আসন্ন শ্রীলঙ্কা সফর পর্যন্ত তিনিই থাকবেন প্রধান কোচ। শ্রীলঙ্কা সিরিজ সামনে রেখে রোডসও সাজাতে শুরু করেন পরিকল্পনা। ঠিক করেছিলেন, বাংলাদেশে গিয়ে ‘এ’ দলের খেলা দেখবেন। কিন্তু দল ঢাকায় যাওয়ার দুই দিনের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল যে লন্ডনের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্ত বদলে গেল? আর চাকরিটা যদি না-ই থাকবে, তাহলে আর রোডসকে দলের সঙ্গে ঢাকায় উড়িয়ে নেওয়া কেন!

বাংলাদেশ দলের সিনিয়র দু-একজন ক্রিকেটারের মত, প্রধান কোচের যতটা বিচক্ষণ হওয়া উচিত, রোডসের সেই বিচক্ষণতা নেই। হয়তো তাঁদের কাছ থেকে শুনেই বিসিবির ওপর মহলেরও সে রকমই ধারণা হয়েছে। কিন্তু উল্টোটাও তো আছে। রোডসকে বিদায় করার আগে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে কি একবার কথা বলেছে বিসিবি? কিংবা দলের তরুণ ক্রিকেটারদের সঙ্গে? বিশ্বকাপের মধ্যেই সাকিব একদিন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রোডসের নেতৃত্বে যে কোচিং স্টাফ, তাঁদের সবচেয়ে ভালো দিক হলো তাঁরা ড্রেসিংরুমে কাউকে আতঙ্কিত করেন না। দলের খারাপ সময়ে তাঁদের নির্ভার থাকতে দেখে খেলোয়াড়েরাও নির্ভার হন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের পর সাকিব বলেছিলেন, ড্রেসিংরুমের চনমনে পরিবেশ তাদের ভালো খেলায় রাখছে বড় ভূমিকা।

বিশ্বকাপে দলের তরুণ ক্রিকেটারদের ভালো খেলায়ও ছিল কোচের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। তরুণদের স্বাধীনভাবে খেলতে বলতেন তিনি। দায়িত্ব নিতে উৎসাহ দিতেন। বিশ্বকাপে কোচের এই নীতির ইতিবাচক প্রভাব দলের মধ্যে দেখা গেছে। পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটারের বিকল্প তৈরি হচ্ছে না, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের আগেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রধান চিন্তা ছিল সেটি। মাশরাফি, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক, তামিমরা যখন থাকবেন না, কী হবে তখন? বিশ্বকাপে লিটন, মোস্তাফিজ, সৌম্য, সাইফউদ্দিন, মোসাদ্দেক, মিরাজের উজ্জ্বল উপস্থিতি সেই দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। বিসিবি এই ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললে জানত, তাঁদের এগিয়ে আসার পেছনে রোডসের অবদান কতটুকু। কোচের বিদায়ে এখন অনেকটা অভিভাবকহীনই হয়ে পড়বেন তরুণ ক্রিকেটাররা। আর তিনি যে শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের নিয়েই চিন্তা করতেন তা নয়, সুযোগ পেলেই ঘরোয়া ক্রিকেট দেখতে এমনকি বিকেএসপি, ফতুল্লায়ও চলে যেতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি বিদেশি কোচদের এমন আগ্রহ এর আগে খুব একটা দেখা যায়নি।

রোডসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর নাকি দলের ওপর প্রভাব নেই। টিম মিটিংয়ে কথা বলেন না। কম্পিউটার-বিশ্লেষক শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরনই ক্রিকেটারদের গেমপ্ল্যান বুঝিয়ে দেন। রোডসের আরেক ‘দোষ’, তিনি বেশি নরম ও ভালো মানুষ। খেলোয়াড়দের প্রতি কঠোর হতে পারেন না। মাঠের পরিস্থিতি অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। এসবেরও ব্যাখ্যা আছে, রোডসকে চলে যেতে বলার আগে যেগুলো হয়তো বিসিবি ঠিকমতো জানারও প্রয়োজন মনে করেনি।

রোডস শ্রীনিবাসকে দিয়ে গেমপ্ল্যান জানাতেন ক্রিকেটারদের সুবিধার কথা ভেবেই। বাংলাদেশ দলের অনেক খেলোয়াড়েরই রোডসের ব্রিটিশ উচ্চারণের ইংরেজি বুঝতে অসুবিধা হতো। সে তুলনায় ভারতীয় শ্রীনিবাসের হিন্দিটা তাঁরা সহজে বুঝতে পারেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তাও ক্রিকেটাররা হিন্দিতেই চালান। তা ছাড়া তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে গেমপ্ল্যান ঠিক করা, কোনো ক্রিকেটারকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা, রোডসের মতামত নিয়েই তো এসব ঠিক করতেন কম্পিউটার-বিশ্লেষক। অন্য সব দলের মতো বাংলাদেশ দলেও তাঁর সাহায্য নিয়ে কোচ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন। ভাষাগত সুবিধার জন্য সেটি ক্রিকেটারদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটাই শুধু ছিল কম্পিউটার-বিশ্লেষকের।

এক বছরের মধ্যে যদি রোডসের এত ব্যর্থতাই ফুটে উঠবে, সে দায়িত্ব কি বিসিবিরও নয়? হাথুরুসিংহে চলে যাওয়ার পর যখন নতুন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করে তখন গ্যারি কারস্টেনকে দিয়ে খুঁজে বের করা হয় রোডসকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কোচিংয়ে যে তাঁর খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই, সেটিও তখনই জানে বিসিবি। সে তুলনায় রোডস যা করেছেন, ভালোই করেছেন। এখন সাধারণ দর্শক-সমর্থকদের মতো যদি বিশ্বকাপে বিসিবির প্রত্যাশাও বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না।

রোডস ভালো মানুষ, নরম-সরম, এসবেও যদি কারও সমস্যা হয়, তাদের তবে ফিরে যাওয়া উচিত চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিদায়ের সময়টায়। চুক্তির মাঝপথে শ্রীলঙ্কান কোচ বিসিবিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে চলে যাওয়ার পর বোর্ড কর্মকর্তারাই বলেছিলেন, যাঁকে নতুন কোচ করা হবে তিনি শুধু ভালো কোচ হলেই চলবে না। ভালো মানুষও হতে হবে। কথায় কথায় ক্রিকেটারদের অপমান করবেন না, চাই এমন কাউকে। হাথুরুসিংহের মধ্যে যেসব নেতিবাচক দিক বোর্ড খুঁজে পেয়েছিল, নতুন কোচের মধ্যে যেসব তারা দেখতে চায়নি। স্টিভ রোডস ঠিক সে রকমই তো মানুষ! এক বছরের মধ্যে বিসিবির রুচি বদলে গেলে, সেটি তো তাঁর সমস্যা নয়। যাঁরা তখন হাথুরুসিংহের আচার-আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই তাঁদেরই এখন ভদ্রলোক রোডসকে পছন্দ হচ্ছে না। রোডসকে নেওয়ার সময় বিসিবির আশা ছিল, তিনি হয়তো ক্রিকেটারদের যোগ্য সম্মানটুকু দেবেন। রোডসের ব্যক্তিত্বের কারণেই ক্রিকেটাররা যখন সেটি পেতে শুরু করলেন, তখন বিসিবি এবং ক্রিকেটারদেরও কারও কারও মনে হতে লাগল, এত ভালো দিয়ে কী হবে! কোচকে তো কঠিন, রুদ্র হতে হবে। সেই কঠিনের আশায় বিসিবি আবারও কড়া নেড়েছে হাথুরুসিংহের, বাংলাদেশ ছেড়ে শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেওয়ার পর যিনি নাকি শুধু বিতর্কেরই জন্ম দিয়েছেন।

আইপিএল-বিগ ব্যাশের বাজারে জাতীয় দলের জন্য ভালো কোচ পাওয়া কত কঠিন, সেটি বিসিবি ভালোই জানে। কোচ বিদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংস্কৃতি কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলবে সন্দেহ নেই।