শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
রকিবুল হাসানের নামের আগে এখন ম্যাচ রেফারি পরিচয়টাই বেশি যায়। তাঁর বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক পরিচয়টাও মনে আছে সবার। শফিকুল হকও ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক। এরপর দীর্ঘদিন ছিলেন জাতীয় দলের ম্যানেজারও। নারী ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন যাঁরা, তাঁরা নিশ্চয়ই কোচ দিপু রায় চৌধুরীর নামটাও শুনছেন। কিন্তু এই প্রত্যেকেরই আরও একটি পরিচয় আছে, যা এখন মানুষ ভুলেই গেছে প্রায়। এই তিনজনই ছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামে খেলা প্রথম জাতীয় দলের সদস্য।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রথম ম্যাচে ছিলেন যারা
শামিম কবির (অধিনায়ক), রকিবুল হাসান (সহ-অধিনায়ক), শফিকুল হক হীরা, মাইনুল হক, ওমর খালেদ, এ এস এম ফারুক, সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ রহমান বাবু, দৌলতুজ্জামান, দিপু রায় চৌধুরী ও খন্দকার নজরুল কাদের লিন্টু।
১৯৭৭ সালের আজকের এই দিনেই প্রয়াত শামিম কবিরের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ দল ঢাকার মাঠে মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচ খেলতে নামে। সেদিনই প্রথমবারের মতো কোনো দলের বিপক্ষে ‘বাংলাদেশ’ নামে খেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা। ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশ দলের কাছে পরীক্ষার মতো। বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলাটা পারে কি না, সেই পরীক্ষা। এমসিসির দলটার সঙ্গে অবশ্য এর আগে রাজশাহী এবং চট্টগ্রামেও দুটি ম্যাচ হয়। তবে সেই ম্যাচ দুটি স্বাগতিক দল খেলেছিল আঞ্চলিক নামে, ‘বাংলাদেশ’ নামে নয়।
মাইনুল হক, ওমর খালেদ, এস এম ফারুক, আশরাফুল হক, ইউসুফ রহমান, দৌলতুজ্জামান, নজরুল কাদেররাও ছিলেন প্রথম বাংলাদেশ দলের সদস্য। টেড ক্লার্কের এমসিসি দলের বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচটিতে ড্রর সুযোগ সৃষ্টি করেও হেরে যায় বাংলাদেশ, তবে জিতে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। মাঠের খেলার সঙ্গে সাংগঠনিক দক্ষতা ও ক্রিকেটের দর্শকপ্রিয়তা—এই সবকিছুই বাংলাদেশকে আইসিসির সহযোগী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। সফর শেষে এমসিসির এক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই বছরের জুনে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। খুলে যায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দুয়ার।
বাংলাদেশের হয়ে প্রথম বলটি খেলেছিলেন রকিবুল হাসান। তাঁর কথায় এখনো জীবন্ত ১৯৭৭ সালের সেই স্মৃতি, ‘৭ জানুয়ারিতে শুরু সে ম্যাচে আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম যে আমরা খেলাটা খেলতে পারি। মাঠভর্তি দর্শক ঢোল–বাদ্যি নিয়ে উপস্থিত। আমরা প্রমাণ করেছি এখানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ছিল। প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিল।’
বাংলাদেশ নামে প্রথম ম্যাচ। সেই ম্যাচ নিয়ে কতই না ঘটনা! দলের মূল দুই পেস বোলারের স্পাইক ছিল না। প্রয়াত পেসার দৌলতুজ্জামান ও বাঁহাতি পেসার দিপু রায় চৌধুরী ঢাকা শহর চষে ফেললেন স্পাইকের জুতো খুঁজতে গিয়ে। ঢাকায় তখন খেলার সরঞ্জামের দোকান খুব বেশি ছিল না। আর কোনো উপায় না পেয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাদা জুতা কিনে ফেলেন দুই পেসার। পুরান ঢাকায় ফুটবলের বুটের দোকানে গিয়ে সেই জুতায় স্পাইক লাগিয়ে এমসিসির বিপক্ষে খেলতে নামেন দিপু রায় ও দৌলতুজ্জামান।
বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার বাংলাদেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের ক্রিকেটারদের জন্য তেমন কিছু করার সামর্থ্য ছিল না। এমনকি পোশাকের ব্যবস্থাটাও ক্রিকেটাররা নিজ উদ্যোগে করেছেন। বোর্ডের পক্ষ থেকে অবশ্য ম্যাচের আগে সবাইকে একটি করে ব্লেজার দেওয়া হয়। ক্রিকেটাররা তাতেই খুশি ছিলেন। দিপু রায় বলছিলেন, ‘আমাদের ২৫ টাকা করে দিত। আমি ফাস্ট বোলার, আমার তো এক বেলাতেই ২৫ টাকা শেষ হয়ে যেত। তবে এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতাম না। আমরা খেলতাম ভালোবাসা থেকে।’
প্রথম বাংলাদেশ দলটাকে দেশের মানুষও কম ভালোবাসা দেয়নি। পূর্বাণী হোটেল থেকে ঢাকা স্টেডিয়াম পর্যন্ত পথটিতে মানুষের ভিড় লেগে থাকত ক্রিকেটারদের একনজর দেখার জন্য। খেলোয়াড়েরা কেউ হোটেল থেকে মাঠে হেঁটেই চলে আসতেন। কারও ব্যাগ ভারী থাকলে আসতেন রিকশায়। দলের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান শফিকুল হক ঐতিহাসিক সে ম্যাচ নিয়ে খুলে দিয়েছেন স্মৃতির ঝাঁপি, ‘হোটেল থেকে মাঠে আসার পথটা এখনো মনে আছে। স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমে তখন বলতে গেলে কিছুই ছিল না। আমাদের খেলার সরঞ্জাম খুব ভালো ছিল না। বল প্যাডে লাগলে পায়ে ব্যথা করত। উইকেটকিপিং গ্লাভসেও অনেক অসুবিধা ছিল।’
কিন্তু স্মরণীয় সেই দিনগুলোর কথা মনে করেও যেন এখন আর কোনো গৌরববোধ করেন না প্রথম বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। তাঁরা নিজেরাও যেন ভুলতে বসেছেন ১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি। কেউ অভিমান থেকে দিনটিকে মনে করতে চান না, কেউ হতাশা থেকে। অভিমান–হতাশার কারণ, দেশের জার্সি প্রথম পরেও তার স্বীকৃতি না পাওয়া। ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই তো প্রথম বাংলাদেশ দলের কোনো ছবি নেই! কোনো ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকেই আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি কোনো সম্মাননা। আজকাল জাতীয় দলের অনেক ক্রিকেটারও নাকি তাঁদের চিনতে পারেন না! কষ্ট থেকে কথাগুলো বলছিলেন দিপু রায় চৌধুরী, ‘সবচেয়ে বড় কষ্টটা কি পাই জানেন? হোম অব ক্রিকেট বলা হয় মিরপুরকে। কিন্তু সেখানে সেই দলের কোনো ছবি দেখা যায় না। কখনো কি জাতীয় দলের কেউ এসে বলেছে যে আপনার সঙ্গে দেখা করে সম্মানবোধ করছি? কেউ না।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্মৃতির ওপরই হয়তো ধুলোর আস্তরণ জমে। তবু ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে জন্মদিন তো আর মুছে যায় না। সাকিব–তামিম–মুশফিকদের যে বাংলাদেশ দলকে এখন গোটা বিশ্ব চেনে, সেই বাংলাদেশ দলের আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।