শুভ জন্মদিন, স্যার ডন

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান: ১৯০৮ সালের এই দিনেই এসেছিলেন তিনি।ফাইল ছবি

মৃত্যুর ওপারে যে রহস্যময় জগৎ, সেখানে কি জন্মদিন উদ্‌যাপনের কোনো রেওয়াজ আছে? থেকে থাকলে আজ মহাসাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হচ্ছে একটি জন্মদিন। বিশাল একটা কেক এসেছে, সেই কেকের ওপর জ্বলছে মোমবাতি। এক ফুঁয়ে যা নিভিয়ে দেওয়া অসম্ভব। কম তো নয়, ১১২টি মোমবাতি!

কল্পনাকে পাখা মেলতে দিলে ক্ষতি কী, মোমবাতিশোভিত সেই কেক ঘিরে দাঁড়িয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমানো ক্রিকেটের সব রথী-মহারথী। তাঁদেরই কেউ হয়তো মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘ওহে ডন, তোমার এই জন্মদিনটা তো স্পেশাল। তোমার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটাও তো ছিল ১১২। মনে আছে তো?’

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান মৃদু হেসে বলছেন, ‘মনে থাকবে না কেন! প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির কথা কি আর কেউ ভুলতে পারে!’

না, প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির কথা কেউই ভোলে না। ব্র্যাডম্যান তো আরও ভুলবেন না। ব্রিসবেনে ১৯২৮-২৯ অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে অভিষেকে ১৮ ও ১ রান করার পর দ্বিতীয় টেস্টে বাদ পড়েছিলেন। মেলবোর্নে পরের টেস্টে দলে ফিরে ওই সেঞ্চুরি। সেটি দ্বিতীয় ইনিংসে, প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ৭৯। এরপর আর কোনো দিন বাদ পড়ার প্রশ্ন ওঠেনি। বরং ওই একবারই যে বাদ পড়েছিলেন, তা পরিণত হয়েছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান নামের অতিমানবকে রক্ত-মাংসের মানুষ বলে প্রমাণ করার একটা মাধ্যম। দল থেকে বাদ পড়লে ক্রিকেটাররা এখনো সান্ত্বনা খোঁজেন, ‘এমনকি ব্র্যাডম্যানও তো ড্রপড হয়ে ছিলেন!’

অতিমানব কেন বলা হচ্ছে, সেই ব্যাখ্যা ক্রিকেটের একটু নিবিষ্ট অনুসারীর কাছেই বাহুল্য বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। ১৯৪৮ সালে খেলা ছাড়ার দুই বছর পর প্রকাশিত হয়েছে ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট নামে আত্মজীবনী। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জীবনীগ্রন্থের সংখ্যা ১১। জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে ১০টি বই ও ৪টি পুস্তিকা। পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখার হিসাব না করাই ভালো। সাধারণের সীমা ছাড়িয়ে অসাধারণত্ব ছোঁয়ার পর স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ‘অতিপ্রাকৃত’ কিছুতে উত্তরণের গল্পই তো লেখা হয়েছে ওসবে। নতুন করে আর কিই-বা বলার আছে!

৫২ শেফার্ড স্ট্রিট। বাউরাল ওভালের পাশের এ বাড়িতেই শৈশব কেটেছে ব্র্যাডম্যানের।
ফাইল ছবি

বলতেই যদি হয়, একটি সংখ্যাই সে জন্য যথেষ্ট। দশমিক-টশমিক মিলিয়ে খটমটে একটা সংখ্যা। অথচ ক্রিকেট অনুরাগী মাত্রেরই সেটি মুখস্থ। ৯৯.৯৪ বললেই সবাই বুঝে ফেলেন কার কথা হচ্ছে। এই গল্পও হয়তো কারও অজানা নয় যে জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে ৪ রান করলেই ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় হতো ঠিক ১০০। ওভালে শেষ ইনিংস খেলতে নেমেছিলেন ১০১.৩৯ গড় নিয়ে। ইংলিশ লেগ স্পিনার এরিক হলিসের গুগলিতে শূন্য রানে বোল্ড হয়ে যাওয়ায় তা তিন অঙ্কের নিচে নেমে আসে। যে ব্যাট থেকে ফল্গুধারার মতো রান ছুটেছে, প্রতি ২.৭৬ ইনিংসে এসেছে একটি সেঞ্চুরি, জীবনের শেষ ইনিংসে সেই ব্যাটেই কোনো রান নেই। এটাও কি তাহলে ক্রিকেট বিধাতার কোনো খেলা! তিনি চেয়েছেন, ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটাও ব্র্যাডম্যানেরই হয়ে থাক!

এই ৯৯.৯৪-এর মহিমা বুঝতে আপনাকে একটু অন্যদের দিকে তাকাতে হবে। টেস্ট ক্রিকেটে কমপক্ষে ২০টি ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় ব্র্যাডম্যানের চেয়ে ৩৬.৫১ কম। যা ব্র্যাডম্যান-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত ভিক্টর ট্রাম্পারের ব্যাটিং গড়ের (৩৯.০৪) প্রায় সমান। ব্যাটিং গড় দিয়ে অবশ্যই ভিক্টর ট্রাম্পারের বিচার হয় না। কেউ তা করতে গেলে নির্ঘাত ক্রিকেট-মূর্খ অপবাদ জুটবে। সেই ঝুঁকি নিয়েও ট্রাম্পারকে টেনে আনার কারণ, ব্র্যাডম্যানের অসাধারণত্ব বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না।

বাউরালে ব্র্যাডম্যান জাদুঘরে কিংবদন্তির ভাষ্কর্য।
ফাইল ছবি

ট্রাম্পারের মতো আরও অনেককেই পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যায় না। ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। তাঁর গ্রেটনেস বোঝাতে সংখ্যাগুলোই তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। এক সিরিজে ৯৭৪ রানের রেকর্ড ভাঙেনি এখনো, এক দিনেই তিন শ (৩০৯) রান করে ফেরার কীর্তিও এখনো অস্পর্শনীয় হয়ে আছে, ৫২ টেস্টে মাত্র ৮০ ইনিংস খেলে ১২টি ডাবল সেঞ্চুরিও তা-ই। ব্র্যাডম্যানের চেয়ে বেশি রান করেছেন আরও অনেকেই, বেশি সেঞ্চুরিও; কিন্তু একটু গভীরে গেলেই বুঝতে পারবেন ২৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার পর সুনীল গাভাস্কারের সেই কথার মর্মার্থ। কী বলেছিলেন গাভাস্কার? ‘আমি আসলে স্যার ডনের রেকর্ড ভাঙিনি। সেটি বলতে পারতাম ৫২ টেস্টে ৩০ সেঞ্চুরি করলে।’

বিশ্বযুদ্ধের কারণে সোনালি সময়ের আট বছর হারিয়েও ৫২ টেস্টে ব্র্যাডম্যানের ২৯ সেঞ্চুরি, রান ৬৯৯৬। সমান টেস্ট খেলে কাছাকাছি রান ও সেঞ্চুরি সুনীল গাভাস্কারেরই। রান ৫০০৭, সেঞ্চুরি ২০টি। এসবই ব্র্যাডম্যানকে ভিনগ্রহের কোনো ব্যাটসম্যান বলে ভুল বোঝার জন্য যথেষ্ট। এর সঙ্গে যোগ করে নিন, বাকিদের আলোকবর্ষ পেছনে ফেলা এই পারফরম্যান্সের সময়টা। ব্র্যাডম্যানের সময় উইকেট ঢাকা থাকত না, নো বলের জন্য ফ্রন্ট ফুট রুল ছিল না। এখন যেমন বোলারদের চার ফুট বক্সের মধ্যে দুই পা-ই রাখতে হয়, তখন শুধু পেছনের পা-টা বক্সে রেখে সামনের পা যত দূর ইচ্ছা এগিয়ে বল করার সুবিধার কারণে বোলাররা ফুট দেড়েক কম দূরত্ব থেকে ছুড়তে পারতেন আগুনের গোলা। ৫৫ ওভার পরই নেওয়া যেত নতুন বল এবং শ্রাবণের ধারার মতো যত ইচ্ছা বাউন্সার দেওয়া যেত। আধুনিক ক্রিকেটের সুরক্ষা সরঞ্জামের কথা আর না-ই বললাম, তখন তো হেলমেটই ছিল না। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন তো ব্যাটে। অ্যাডিলেড ওভালের জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা ব্র্যাডম্যানের ব্যাট দেখেছি, সিডনি থেকে ১১৭ কিলোমিটার দূরে বাউরালে ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামেও। দেখেছি আর অবাক হয়ে ভেবেছি, এই ব্যাট দিয়ে দিনের পর দিন কীভাবে সম্ভব অমন তাণ্ডব চালানো! সাম্প্রতিক কিছু বিধিনিষেধের পরও এখনকার ব্যাটের কানাই তো ব্র্যাডম্যানের ওসব ব্যাটের প্রায় ব্লেডের সমান। মিস হিটেই ছক্কা এনে দেওয়া আধুনিক ব্যাট পেলে ব্র্যাডম্যান কী করতেন ভাবতে গেলেও গা শিউরে ওঠে।

ব্র্যাডম্যানকে বুঝতে তাই ব্র্যাডম্যানেই ভরসা করতে হয়। যা শুধু ক্রিকেটের সীমানায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। বিখ্যাত অঙ্কবিদ টমাস হার্ডি তাই ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে একটা টার্ম বের করেছিলেন। যেটি ছিল মানবীয় অন্য কীর্তির চূড়ান্ত মানদণ্ড। হার্ডির চোখে গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনরা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ‘ব্র্যাডম্যান ক্লাস’ বলে।

শুধু ক্রিকেটার কেন, মানুষটাও তো অবিশ্বাস্য। আত্মজীবনীটা পড়লেই যা কিছুটা বুঝতে পারবেন। তার চেয়েও বেশি বুঝতে পারবেন রোনাল্ড পেরির গল্পটা শুনলে। ব্র্যাডম্যানের মৃত্যুর পর প্রকাশিত বহুল আলোচিত ব্র্যাডম্যানস্ ইলেভেন বইয়ের লেখক এই পেরি। দ্য ডন নামে ব্র্যাডম্যানের জীবনী লিখেছেন আরও আগে। এই বইয়ের জন্যই ১৯৯৫ সালে ডনের কয়েকটি ইন্টারভিউ নিয়েছেন। তখনই বলে নিয়েছিলেন, এটা হবে আনঅথরাইজড জীবনী। অর্থাৎ জীবনীকারের যা মনে হয়, তা-ই লিখবেন। বই প্রকাশের আগে ব্র্যাডম্যান ফোন করে পাণ্ডুলিপি দেখতে চাওয়ায় পেরি তাই একটু বিব্রতই হয়েছিলেন। যা বুঝতে পেরে ব্র্যাডম্যান আশ্বস্ত করেন, তিনি শুধু তথ্যগত কোনো ভুল আছে কি না, সেটিই দেখতে চান।

মেলবোর্ন থেকে এয়ার এক্সপ্রেসে অ্যাডিলেডে পাঠানো আড়াই লাখ শব্দের ওই পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ব্র্যাডম্যান পেরিকে ফোন করে বললেন, তাঁর পড়া শেষ। চার পৃষ্ঠা নোট নিয়েছেন। ৮০টা পয়েন্ট নিয়ে পেরির সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। বিস্ময়াভূত পেরি পরদিন অ্যাডিলেডে ব্র্যাডম্যানের বাড়িতে পৌঁছালেন। তাঁকে নিয়ে স্টাডিতে বসলেন ব্র্যাডম্যান, হাতে ওই নোট। ৮০টা পয়েন্টের বেশির ভাগই বানান বা সংখ্যার ভুল। সেসব দ্রুত মিটে গেল। তবে একটা বিষয়ের মীমাংসায় অনেকটা সময় লাগল। পেরি লিখেছিলেন, ১৯৩০ সালে লর্ডসে ব্র্যাডম্যানের ২৫৪ রানের ইনিংসের প্রথম রানটা ছিল মিড অনে খেলে। ব্র্যাডম্যানের দাবি, মিড অন নয়, মিড অফ। পেরি মিড অনেই অনড় থাকায় ব্র্যাডম্যান তথ্যসূত্র জানতে চাইলেন। তিনজনের নাম বললেন পেরি। ব্র্যাডম্যান তা শোনার পর চোখ বন্ধ করে মনে মনে যেন শটটা আবার খেললেন। চোখ খুলে বললেন, ‘না, ঠিক করে দিন, ওটা মিড অফেই খেলেছিলাম।’ বলে দিলেন ফিল্ডারের নামও। ১৯৩১ সালে একটা প্রদর্শনী ম্যাচে ব্র্যাডম্যানের মাত্র তিন ওভারে (আট বলের ওভার) করা বিখ্যাত ওই সেঞ্চুরির বর্ণনায় শটের ক্রমপর্যায়ে একটা ভুল ছিল, সেটিও ঠিক করে দিলেন। রোনাল্ড পেরি যখন ব্র্যাডম্যানের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখন তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ়।

শুধুই একজন ক্রিকেটার নন, এমন বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়া এক অনুভূতির নামই স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।

শুভ জন্মদিন, স্যার ডন!