সমর্থকদের মাথাব্যথা কমানোর কথা ভাবছে আইসিসি

মাঠের সিদ্ধান্তগুলো নিখুঁত করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম বা ডিআরএস। মাঠের আম্পায়াররা সিদ্ধান্ত নিতে সেকেন্ডেরও কম সময় পান। ফলে অনেক সময় তাঁদের সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে। ইতিহাসে বহুবার এমন হয়েছে যে আম্পায়ারের একটা ভুল সিদ্ধান্ত ম্যাচের গল্প বদলে দিয়েছে। সেটা দূর করার জন্যই ডিআরএসের জন্ম। টেনিসেও রিভিউ পদ্ধতি চালু হয়েছে। শেষমেশ গতি খেলা ফুটবলকেও থমকে দিয়ে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর) চালু হয়েছে।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, তা অবশ্য পূরণ হচ্ছে না। ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমন দিন খুব কমই যাচ্ছে, যেদিন ভিএআর নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে না। ভিএআর কেন, কখন, কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেটা বুঝতে মাথা খারাপ হওয়ার দশা। ক্রিকেট–সমর্থকদের অবশ্য এমন দশা আরও বহু আগে থেকেই। রিভিউ নেওয়ার পর টিভি আম্পায়ার যে ডিসিশন দিচ্ছেন, সেগুলা মেনে নেওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

যেকোনো দর্শকের জন্যই সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর বিষয়টি হলো ‘আম্পায়ার্স কল’। এই শব্দ যুগলই সবচেয়ে বিভ্রান্ত করছে সমর্থকদের। অবশেষে টনক নড়েছে আইসিসির। ক্রিকেট থেকে আম্পায়ার্স কল ফেলে দেওয়ার কথা ভাবছে তারা।

ক্রিকেটে ‘ডিআরএস; নিয়ে পরিবর্তনের কথা ভাবছে আইসিসি।
ফাইল ছবি

আম্পায়ার্স কল কী

প্রথমেই একটু পেছনে যাওয়া যাক। কোনো আউটের আবেদন হলেই সেটার জবাব দুভাবে দেন আম্পায়াররা। হয় আউট, নয়তো নট আউট। এটাই আম্পায়ার্স কল এবং এলবিডব্লু সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এটা অনেক বড় ভূমিকা রাখে। রিভিউতে বল ট্র্যাকিং সিস্টেমে বলের সম্ভাব্য গতিপথ দেখা হয়। একটি রিভিউতে তিনটি জিনিস দেখা হয়। বলটা লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়েছে কি না, বল পায়ে আঘাত হানার সময় স্টাম্পে ছিল কি না এবং বলের সম্ভাব্য গতিপথ শেষ পর্যন্ত স্টাম্পেই থাকত কি না। এ তিনটি মাপকাঠি যদি মানে অর্থাৎ যদি সবুজ হয়, তাহলে ব্যাটসম্যানকে আউট দেওয়া হয়। আর যেকোনো একটি লাল হলেই ব্যাটসম্যান বেঁচে যাবেন। আবেদন করেও আম্পায়ারকে ভুল প্রমাণ করতে না পারলে রিভিউ নষ্ট হবে আবেদনকারী দলের।

এটুকু পর্যন্ত সবার সবকিছু বুঝতে কোনো সমস্যা নেই। ঝামেলাটা হলো লাল বা সবুজের বদলে হলুদ হলে। আইসিসির বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, ‘নট আউটের সিদ্ধান্ত বদলাতে হলে প্যাডে আঘাত হানার সময় বলের অর্ধেকের বেশি স্টাম্পে থাকতে হবে। বল ট্র্যাকিংয়ে স্টাম্পে আঘাত হানার সময় ডান বা বাঁ স্টাম্পে অন্তত অর্ধেকের বেশি আঘাত হানতে হবে। আর ওপরের দিকে বেলের নিচের অংশে বলের অর্ধেকের বেশি থাকতে হবে।’

‘আম্পায়ারর্স কল’ একটা বড় বিভ্রান্তি
ফাইল ছবি

অর্ধেকের বেশি না থাকলেই সেটা হলুদ বলে ভাবা হয়। অর্থাৎ সিদ্ধান্তটি নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আম্পায়ার্স কলই গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ আম্পায়ার সে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, সেটাই থেকে যাবে। আবার আবেদনকারী দলের রিভিউ নষ্ট হবে না।

শুধু এলবিডব্লু নয়, আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে আম্পায়ার্স কল ঝামেলা সৃষ্টি করছে। কদিন আগেই চেন্নাইয়ে দ্বিতীয় টেস্টে জো রুটের আউট নিয়ে যেমন ঝামেলা সৃষ্টি হলো। অক্ষর প্যাটেলের একটি বল রুটের প্যাডে লেগে যায় এক ফিল্ডারের হাতে। ভারত জোরালো আবেদন করে। আম্পায়ার নট আউটের সিদ্ধান্ত দেন। আম্পায়ার নীতিন মেননের মনে হয়েছে বল প্যাডে আঘাত হানার সময় স্টাম্পে ছিল না। তৃতীয় আম্পায়ার দেখে জানিয়েছেন আম্পায়ার্স কল। অর্থাৎ বল স্টাম্পে ছিল, কিন্তু পঞ্চাশ ভাগে কম ছিল। যদিও হক আই প্রযুক্তি ছাড়া খালি চোখে দেখলে রুটের অফ স্টাম্প দেখা যাচ্ছিল।

ভারত তাই এ সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি। অধিনায়ক বিরাট কোহলি এ নিয়ে অনেকক্ষণ তর্ক চালিয়েছেন। এ নিয়ে কোহলির সমালোচনা করেছেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটাররা। তবে এটাও স্বীকার করেছেন, আম্পায়ারের সিদ্ধান্তটা খুব বাজে ছিল। কিন্তু যেহেতু আম্পায়ার্স কল, তাই রিপ্লে দেখে যতই বোঝা যাক, সেটা আউট ছিল, সিদ্ধান্ত বদলানোর উপায় ছিল না। আম্পায়ার্স কল নিয়ে বিভ্রান্তি তাই দিন দিন বাড়ছে। এমসিসির বিশ্ব ক্রিকেট কমিটি তাদের প্রথম মিটিংয়ে তাই আম্পায়ার্স কল বাদ দেওয়া যায় কি না, সে আলোচনা করেছে।

মাইক গেটিং, সুজি বেটস, অ্যালিস্টার কুক, কুমার ধর্মসেনা, সৌরভ গাঙ্গুলী, রিকি পন্টিং, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, রমিজ রাজা, কুমার সাঙ্গাকারা, শেন ওয়ার্নদের মতো কিংবদন্তিদের নিয়ে গঠিত এমসিসি কমিটি এ নিয়ে আলোচনা করেছে। তাতে অধিকাংশ সদস্যই এটা বাদ দেওয়ার পক্ষে মত জানিয়েছেন। এমসিসি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ডিআরএসে এলবিডব্লুর ক্ষেত্রে আম্পায়ার্স কল ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছে। বিশেষ করে একই বলে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন আউট বা নট আউট দুটিই হতে পারে, এটা দেখে সমর্থকেরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের ধারণা, মাঠের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব না দিয়ে সরাসরি আউট বা নট আউট দিয়ে দিলেই সবার জন্য ভালো। কোনো আম্পায়ার্স কল নয়।’

বিবৃতিতে সদস্যদের নতুন প্রস্তাবের কথাও বলা হয়েছে, ‘স্টাম্পের হিটিং জোন (স্টাম্পের বাইরের দিক) আগের মতোই থাকবে। এবং আউট হতে হলে বলের অন্তত পঞ্চাশ ভাগ স্টাম্পে থাকতে হবে। আর এটা চালু হলে তাদের ধারণা, অন্য রিভিউগুলোকে ব্যর্থ বলে গণ্য করা হোক।’ বর্তমানে পঞ্চাশ ভাগের কম থাকলে সিদ্ধান্ত বদলানো হয় না, আবার রিভিউ নষ্ট হয় না। কিন্তু কমিটি চাচ্ছে আম্পায়ার্স কল বাতিল হবে, আর নট আউট বা আউটে নিজের পক্ষে সিদ্ধান্ত না পেলে রিভিউও নষ্ট হোক।

তবে কিছু সদস্য এখনো আম্পায়ার্স কলের পক্ষে। তাদের ধারণা মাঠের আম্পায়ারও মানুষ এবং তার পক্ষে যে ভুল হতে পারে, সে মানবিক দিকটাও হিসেবে আনা উচিত। তাদের মনে হচ্ছে বহুদিন ধরেই যেহেতু এটা ক্রিকেটে আছে, এত দিনে সমর্থকদের এটা বুঝে ফেলা উচিত! এমসিসি জানিয়েছে, তাদের এই মতামত আইসিসির ক্রিকেট কমিটিতে জানানো হবে। মাঠের আরেকটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনতে বলছে এমসিসি কমিটি। বর্তমানে বোঝা যাচ্ছে না এমন ক্যাচ আউটের ক্ষেত্রেও আম্পায়ার্স কল ভূমিকা রাখে। সে ক্ষেত্রে আম্পায়ার মাঠ থেকে সফট সিগন্যাল দেন, আউট বা নট আউটের। টিভি আম্পায়ার যদি বারবার দেখেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে সফট সিগন্যালই মূল সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। কমিটি বলছে, ৩০ গজ বৃত্তের মধ্যে সফট সিগন্যাল ভালোই কাজে দিচ্ছে। কিন্তু এর বাইরের ক্যাচ বিশেষ করে সীমানাদড়ির কাছের সিদ্ধান্ত আম্পায়ারের পক্ষে সফট সিগন্যাল দেওয়া সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে দেখিনি বলে টিভি আম্পায়ারের কাছে পাঠাতে পারেন।