সাকিব আল হাসান

নাম

সাকিব আল হাসান

জন্ম

মার্চ ২৪, ১৯৮৭, মাগুরা

ধরন

অলরাউন্ডার

অভিষেক

বনাম জিম্বাবুয়ে, আগস্ট ৬,২০০৬

প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশের ক্রিকেট, সেখানে সাকিব আল হাসানের নাম নিঃসন্দেহে চলে আসবে একদম শুরুতেই। আগ্রাসী একজন বাঁহাতি মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান, কৌশলী বাঁহাতি স্পিনার, কিংবা তর্কসাপেক্ষে অন-দ্য-ফিল্ড এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডার‍। কোথায় নেই সাকিব! সাকিব আল হাসান এবার বিশ্বকাপে যাচ্ছেন বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হিসেবেই।

মাগুরায় খেলতে খেলতেই প্রথম নজরে পড়েছিলেন স্থানীয় কোচ সাদ্দাম হোসেন গোর্কির। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। বিকেএসপি হয়ে ঢুকে পড়েছেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে, সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ‘মিনি অলরাউন্ডার’ কোটায় সোজা জাতীয় দলে। অভিষেকটাও ছিল দারুণ, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মিডল-অর্ডারে খেলতে নেমে ৩০ রানের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর ইনিংস খেলেছিলেন, এর আগে বল হাতেও মাত্র ৩৯ রানে নিয়েছিলেন এলটন চিগুম্বুরার গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।

সাকিব আল হাসানের প্রথম সেঞ্চুরি ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঠিক আগে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে কানাডার বিপক্ষে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে আগ্রাসী এক অর্ধশতকে গড়ে দিলেন বাংলাদেশের জয়ের ভিত, এরপর ওই বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে হাঁকালেন ব্যক্তিগত দ্বিতীয় শতক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখলেন কী ঝলমলে ঔজ্জ্বল্যে!

টেস্টেও অব্যাহত রইল এই পারফরম্যান্স। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে হঠাৎই কোচ জেমি সিডন্স ঘোষণা করলেন, এই ম্যাচে মূল স্পিনার হিসেবে খেলবেন সাকিব। সবার চক্ষু চড়কগাছ। সাকিবের পরিচয় যে তখন ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিংও পারেন—এমন অলরাউন্ডারের। ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিলেন সাকিব, প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩১ রানেই তুলে নিলেন ৭টি উইকেট! ব্যাট হাতে পর দ্বিতীয় ইনিংসে একটি ফিফটিও করেছিলেন সেই ম্যাচে।

ব্যাটে-বলে দারুণ পারফর্ম করে ধারাবাহিকতার পরম নিদর্শন স্থাপন করে খুব দ্রুতই উঠে এলেন ওয়ানডে ফরম্যাটে অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থানে। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ও যে এই উচ্চতায় উঠতে পারেন, সেই বিশ্বাস তো জন্ম দিলেন তিনিই! নিমেষেই বদলে দিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মনস্তত্ত্ব, বদলে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের চেহারাও।

এরপর নিজেকে আরও ওপরে নিয়ে গেছেন সাকিব। অলরাউন্ডার হিসেবে ছড়িয়েছে সুনাম, পারফরম্যান্সে ক্রমাগত ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ২০০০ রান ও ১০০ উইকেট ডাবল , বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে হাঁকিয়েছেন পাঁচটি শতক, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে খেলেছেন কাউন্টি ক্রিকেট।

২০০৯ সালে উইন্ডিজ সফরে মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে টেস্ট খেলতে নামলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে গুরুতর ইনজুরিতে মাঠের বাইরে চলে যান মাশরাফি, নেতৃত্বের গুরুভার এসে পড়ে তরুণ সাকিবের ওপরই। পরবর্তীতে সেই সিরিজ বাংলাদেশ জেতে ৩-০ ব্যবধানে, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সাকিব নিজেই। সেই বছরই জিতেছিলেন ‘উইজডেন টেস্ট প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাব।

কাউন্টি ক্রিকেট সাকিবকে পারফরমার হিসেবে করে তুলেছিল আরও পরিশীলিত। সেটার প্রমাণ রেখেই ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ‘বাংলাওয়াশ’-এর স্বাদ দেয় টাইগাররা, যাতে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক এবং সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ছিলেন সাকিবই। তাঁর অধীনে সেই দফায় ৪৭ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছিল ২২ ম্যাচ, ২০১১ বিশ্বকাপে জিতেছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও। তবু শেষ রক্ষা হলো না।

যেই উইন্ডিজের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব এসেছিল তাঁর কাঁধে, সেই উইন্ডিজেই ২০১১ সালে খোয়ালেন অধিনায়কত্ব। তবে পারফরম্যান্সে জং ধরেনি বিন্দুমাত্র, হয়ে উঠেছেন আরও অদম্য, প্রমাণ করেছেন নিজেকে। ওই বছরই টেস্ট ফরম্যাটে অলরাউন্ডার র‍্যাঙ্কিংয়ে উঠে এলেন শীর্ষে।

তবে বিতর্ক পিছু ছাড়ল না তাঁর। ২০১৪ সালে ‘শৃঙ্খলাজনিত কারণে’ ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হলেন, তবে বিশ্বকাপ দুয়ারে চলে আসার কারণে সেটাকে কমিয়ে নিয়ে আসা হয় সাড়ে তিন মাসে। ওই বছরেরই নভেম্বরে ইয়ান বোথাম এবং ইমরান খানের পাশাপাশি ইতিহাসের মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এক টেস্টে শতক এবং দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি স্থাপন করেন সাকিব। ডিসেম্বরে খেললেন বিগ ব্যাশে, অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লিগে খেলা বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় সাকিব।

ক্রিকেট ইতিহাসেই টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি তিন ধরনের ক্রিকেটে একই সময়ে এক নম্বরে থাকা একমাত্র ক্রিকেটার তিনি। ২০১৫ সালে সাকিব এই কৃতিত্ব প্রথম করে দেখান। সাকিব নিজে নিজের এই কৃতিত্ব আবার করে দেখিয়েছেন, যা আর কোনো দেশের ক্রিকেটার পারেননি। আরেকটি অলরাউন্ড কৃতিত্বে সাকিব অনন্য হয়ে আছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান ও ২০০ মাইলফলক স্পর্শ করেন। মাত্র ১৭৮টি ওয়ানডে লেগেছে তাঁর। এত দ্রুত এই কৃতিত্ব আর কেউ করতে পারেনি। সাকিব টেস্ট ইতিহাসে তিন অলরাউন্ডারের একজন, একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আর ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব আছে যাঁদের।

বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট সাকিবের। ওয়ানডেতেও সবচেয়ে বেশি উইকেটের লড়াইটা চলছে মাশরাফি বিন মুর্তজার সঙ্গে। টেস্টে ৯ প্রতিপক্ষের সবার বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া ইতিহাসের মাত্র চতুর্থ বোলার সাকিব।

বাংলাদেশের অনেক প্রথমের সূচনাকারী সাকিব আল হাসান এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন এমন এক মাইলফলকের সামনে, যেখানে তাঁর আগে পৌঁছাতে পেরেছেন কেবল জ্যাক ক্যালিস এবং শহীদ আফ্রিদি। ওয়ানডে ক্রিকেটে পাঁচ সহস্রাধিক রান ও আড়াই শতাধিক উইকেটের ডাবল পূর্ণ করতে তাঁর প্রয়োজন কেবল আর একটিই উইকেট। বাংলাদেশের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে চলেছেন দুই শতাধিক ওয়ানডে। ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপেও তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ, স্বপ্নের সীমানাটা বড় করতে শিখিয়েছেন তো তিনিই! সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশ টিম টাইগার্সের সবচেয়ে ক্ষিপ্র বাঘ—তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই!

[সকল তথ্য-উপাত্ত এই বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত]