সাবেক অধিনায়কদের চাওয়া রুটের বিদায়

দিন শেষ হয়ে আসছে জো রুটেরছবি: রয়টার্স

টেস্ট ক্রিকেটই ইংল্যান্ডের ধ্যানজ্ঞান। অন্য সব দলের চেয়ে টেস্ট বেশি খেলে ইংল্যান্ড। এক সময় সংক্ষিপ্ত সংস্করণে দলটির ছন্নছাড়া পারফরম্যান্সের পেছনে এর ভূমিকা ছিল বলে অনেকেই মনে করতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে ইংল্যান্ড। ওয়ানডে বিশ্বকাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়নও তারাই। এর মধ্যেও টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি ইংল্যান্ডের। প্রথম দল হিসেবে এক হাজার টেস্ট খেলার রেকর্ড ইংল্যান্ডের। আর সে দলের এই অবস্থা!

অ্যাশেজে হারের দুঃখ সয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সেখানেও সিরিজ হেরে বসেছে জো রুটের দল। এ নিয়ে টানা পঞ্চম সিরিজ হারল ইংল্যান্ড। টেস্ট ইতিহাসে একাধিক ম্যাচের সিরিজে এমন টানা ব্যর্থতা ইংল্যান্ডকে কখনো দেখতে হয়নি। এই অবস্থায় কোচ-অধিনায়কদের দায়িত্ব কেড়ে নেওয়ার দাবি ওঠাটাই স্বাভাবিক। অ্যাশেজের পর কোচ সিলভারউড চাকরি খোয়ালেও জায়গা ধরে রেখেছিলেন অধিনায়ক জো রুট। এবার তাঁকেও বাদ দেওয়ার সময় এসেছে বলে মত জানিয়েছেন সাবেক তিন অধিনায়ক।

রুটকে সরে যেতে বলছেন তিন সাবেক অধিনায়ক—মাইকেল ভন, নাসের হুসেইন ও মাইক আথারটন
ছবি: সংগৃহীত

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ হারের পরও দায়িত্ব ছাড়তে চাইছেন না রুট। ইংল্যান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয় ও হার দুটিরই রেকর্ড গড়া অধিনায়ক বরং সামনেই অবস্থাটা বদলাবে বলে আশাবাদী, ‘ড্রেসিংরুম এখনো আমাকে সমর্থন দিচ্ছে এবং আমি খুব করে তাদের হাসি ও উদ্‌যাপন করা দেখতে চাই। কারণ, আমার মনে হচ্ছে সেটা খুব বেশি দূরে নয়।’

অধিনায়কত্ব করে যেতে চান কি না, সরাসরি এই প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘আমি এটা আগেই পরিষ্কার জানিয়েছি। আমার শক্তিতে যতটুকু সম্ভব, আমার হাতে যা আছে, সেটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমি। ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জেতাতে যা সম্ভব তা-ই করব, এটার কোনো বদল হবে না।’

তাঁর এমন আবেগের অবশ্য কোনো মূল্য নেই মাইকেল আথারটন, নাসের হুসেইন ও মাইকেল ভনের কাছে। তিনজনই রুটের অধিনায়কত্ব কেড়ে নিতে বলছেন।

গত কিছুদিন ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচের নিয়মিত দৃশ্য
ছবি: রয়টার্স

গতকাল অধিনায়ক হিসেবে ২৬তম টেস্ট হেরেছেন রুট। ইংল্যান্ডের কোনো অধিনায়কের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ হারার রেকর্ড তো বটেই, টেস্ট ইতিহাসেই এর চেয়ে বেশি হেরেছেন মাত্র দুজন—নিউজিল্যান্ডের স্টিভেন ফ্লেমিং (২৭ ম্যাচ) আর দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ (২৯ ম্যাচ)।

অ্যাশেজের পরই রুটকে সরে যেতে বলেছিলেন আথারটন। ‘দ্য টাইমসে’ নিজের কলামে আরও একবার সে দাবি তুলেছেন সাবেক অধিনায়ক, ‘রুটের অধিনায়কত্ব অগ্রহণযোগ্য এবং নিশ্চয়ই মনে মনে সে-ও জানে এটা। ওর দল এ নিয়ে টানা ৫টা সিরিজে জয় পায়নি এবং ১৭ টেস্টের মাত্র ১টিতে জিতেছে। এত ভালো সব খেলোয়াড় থাকা এক দলের জন্য এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে!’

আথারটন একদম পরিষ্কার ভাষায় রুটের অধিনায়কত্বের শেষ টানতে বলেছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় যারা ছিলেন এবং যারা ছিলেন না—সবার কাছেই এটা পরিষ্কার যে, অধিনায়ক হিসেবে রুটের যাত্রা শেষ। একটা পরিবর্তন সব সমস্যা দূর করবে না—এটা খুব বাজে দল এবং ইংল্যান্ড প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে অবহেলা করার মূল্য দিচ্ছে। কিন্তু একটা সময় আসে যখন একজন অধিনায়কের কোনো কিছু দেওয়ার থাকে না, নতুন খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে নতুন কিছু বলার থাকে না। সে সময়ে ভিন্ন ধরন বা ভিন্ন কণ্ঠ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।’

শেষ টেস্টে ব্যাট হাতেও হতাশ করেছেন রুট
ছবি: রয়টার্স

২০১৭ সালে দায়িত্ব পাওয়া রুটের এখনো অধিনায়ক থাকার ইচ্ছাই বিস্মিত করছে আথারটনকে, ‘ওর এ অবস্থা অ্যাশেজেই বোঝা গেছে এবং এরপর কিছুই বদলায়নি। তখনই শেষ করে দিলে ব্যাপারটা সুন্দর হতো। এখন এই দায়িত্ব নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিতে হবে। গত রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ পদের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল। অস্ট্রেলিয়ার পরও কীভাবে রুটের মনে হলো ওর (অধিনায়ক হিসেবে) থেকে যাওয়ার অধিকার আছে কিংবা অন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সবাই চাকরি হারানোর পরও সে কীভাবে রয়ে গেছে, সেটা রহস্যজনক। যা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে।’

আথারটনের কাছ থেকে যিনি ইংল্যান্ড–অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই নাসের হুসেইন তো রুটের আদৌ অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা ছিল কি না, এ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। ‘ডেইলি মেইল’–এর কলামে লিখেছেন, ‘রুট একজন বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান এবং পছন্দ করার মতো মানুষ। কিন্তু আমার মনে হয় না ওর মধ্যে অধিনায়ক হওয়ার মতো সহজাত কিছু ছিল। রুট ও পল কলিংউডের অধীনে ইংল্যান্ড দল ওয়েস্ট ইন্ডিজে এমন পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছে যেন ওরা সবাই বন্ধু এবং সবাই একটা দল হিসেবে আছে। তারা পছন্দনীয় এক দল হওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু টেস্ট জেতার জন্য এটাই যথেষ্ট নয়।’

স্টোকসকে অধিনায়ক দেখতে চান নাসের
ছবি: রয়টার্স

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে দুই অভিজ্ঞ বোলার জিমি অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রডকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও মানতে পারছেন না হুসেইন। রুট এখন ‘জ্বী হুজুর’দেরই দলে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ তাঁর, ‘মাঝেমধ্যে আপনার শক্ত চরিত্রের লোক লাগে, যাদের সামলানো কঠিন। সামলানো কঠিন—এমন লোকদের বাদ দিয়ে ১০টা জ্বী হুজুর নিয়ে দল গড়ার চেষ্টা করা হয়েছে, এটা দায়িত্বে অবহেলা ছাড়া আর কিছু নয়। অধিনায়কত্বের মূল ব্যাপার, অন্তত আমি যেটা সবচেয়ে পছন্দ করতাম, সেটা হলো, যারা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে, তাদের সেরাটা বের করে নেওয়া।’

হুসেইন মনে করেন ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটা এখন বেন স্টোকসের পাওয়া উচিত, ‘যদি জো নিজ থেকে সরে না যায়, তবে অন্য কেউ সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিক। নতুন কোচের উচিত বেন স্টোকসের সঙ্গে বসা এবং জিজ্ঞাসা করা মাঠের বাইরে মানসিকভাবে সে কেমন আছে, খেলার দিকটায় কেমন আছে। বেনকে দেখে মনে হচ্ছে আবার আবেগ দিয়ে খেলছে, সেই আগুন দেখা যাচ্ছে। স্টোকসের কথা শুনে কোচের যদি ভালো লাগে, তবে তাকেই সে দায়িত্ব দেওয়া হোক।’

মাঠে দলকে অনুপ্রাণিত করতে পারছেন না রুট
ছবি: রয়টার্স

নাসের হুসেইনের কাছ থেকে ইংল্যান্ডের দায়িত্ব পাওয়া মাইকেল ভন রুটের কৌশলগত সমস্যার দিকেই নজর দিয়েছেন। তাঁর মনে হচ্ছে প্রায়ই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন রুট। ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে’ তিনি লিখেছেন, ‘গ্রেনাডাতে এটা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় বারবার হয়েছে এবং গত গ্রীষ্মে অনেকবার হয়েছে। এটা নিয়মিত দেখা যাচ্ছে, চাপে পড়লে রুটের ইংল্যান্ড সেটা সামলাতে পারে না। যখনই এমন একটা ঘণ্টা আসে যেখানে জেতা দরকার, তারা সেটা হারে।’

নিজের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও মনে করিয়ে দিয়েছেন ভন, ‘২০০৮–এর গ্রীষ্মের আগেই আমি জানতাম, আমি সরে যাব। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে কখন আপনার দৌড়ের সমাপ্তি, সেটা জানতে হবে। জো-র উচিত নিজেকেই জিজ্ঞাসা করা —আগামী দেড় বছর নিজেকে টানার শক্তি তার আছে কি না? দল কি তার কথা শুনছে? দলের অবস্থা কিন্তু তা বলছে না।’

রুট সরে গেলে দলের কেন লাভ হবে, সেটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ভন, ‘আমাদের প্রশ্ন রাখা উচিত, জো রুট অধিনায়ক না থাকলে ইংল্যান্ড আসলেই খারাপ করবে কি না? আমরা কোনটার অভাব বোধ করব? আমরা তার রানের অভাব বোধ করব না, কারণ, সে তো রান করবেই। মাঠে তার কৌশলের অভাব বোধ করব? না। ওর যদি এখনো প্রাণশক্তি থাকে এবং অতীতের কোচরা যা পারেনি, নতুন কোচ যদি তাকে সাহায্য করতে পারে, তাহলে হয়তো সে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে আমার এতে সন্দেহ আছে।’