সিরাজ যেভাবে ‘নবাব’ হলেন

ভারতীয় বোলিংয়ের মধ্যমণি হয়ে উঠছেন মোহাম্মদ সিরাজ।ছবি: এএফপি

‘এই টেস্ট সিরিজে তুমি ইনিংসে পাঁচ উইকেটের দেখা পাবে। তোমার বাবার দোয়া আছে তোমার সঙ্গে,’ মোহাম্মদ সিরাজ এ কথা শুনেছিলেন দুজন প্রধান কোচের কাছ থেকে। গত নভেম্বরে তাঁর বাবা মারা যান। এরপর প্রথম অনুশীলনে নামার সময় দুজন কোচের এই মন্ত্রণা ঠিক দুই মাস পর অলৌকিকভাবে ফলে গেল!

তা-ও একেবারে সিরিজের শেষ টেস্টে, প্রতিপক্ষের শেষ ইনিংসে। দলের জন্য সিরাজের ধৈর্য ও নিবেদনের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়ে ছেড়েছে এই অস্ট্রেলিয়া সফর। বাবাকে তিনি হারান এ সফরের সময়ই। কিন্তু দেশে ফিরে যাননি, থেকে যান দলের সঙ্গে। মোহাম্মদ শামি চোট পাওয়ার পর মেলবোর্নে তাঁর টেস্ট অভিষেক ঘটেছে বুকে পাথর বেঁধে। ব্রিসবেনে এসে সিরাজই দলের মূল পেসার! সিনিয়রদের মধ্যে চোটের মিছিল শুরু হওয়ায় ভারতীয় পেস আক্রমণের পতাকা বইতে হয়েছে মাত্র ২ টেস্ট খেলা সিরাজকে। পতাকা তিনি কতটা বইতে পারলেন, তা পরিষ্কার বোঝা গেল ভারতীয় সংবাদকর্মী ভরত সুন্দর্শনের টুইটে। দুই কোচের সেই কথা টুইট করে সুন্দর্শনের শেষ কথা, ‘জন্ম হলো এক তারকার।’

ব্রিসবেনে আজ চতুর্থ দিনে এসে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট পান ২৬ বছর বয়সী পেসার। ১৯.৫ ওভার বল করে খরচ ৭৩ রান। ভারতীয় বোলিংয়ের ‘নেতা’ হিসেবে শিকার করেছেন প্রতিপক্ষের সেরা দুই বাজির ঘোড়া স্টিভেন স্মিথ ও মারনাস লাবুশেনকে। পরে ম্যাথু ওয়েড এবং ‘লেজ’-এর মারকুটে মিচেল স্টার্ক ও জশ হ্যাজেলউডকেও তুলে নিয়ে ‘নবাবি’ করেছেন লাল বলে।

টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ৫ উইকেট পেয়েছেন মোহাম্মদ সিরাজ।
ছবি: এএফপি

এই সিরাজের উন্মেষের সময় হায়দরাবাদের এক কোচিংয়ে ভর্তি করার টাকা ছিল না অটোচালক বাবার। সিরাজকে ভর্তি হতে হয়েছিল প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে। অনুশীলনে যেতে বাবার কাছ থেকে প্রতিদিন হাতখরচ পেতেন ৭০ রুপি। যাতায়াত, খাওয়াদাওয়া—সব এর মধ্যেই। ওদিকে এই টাকায় স্কুটির তেলের খরচ জোটাতেই হাঁসফাঁস উঠে যেত সিরাজের। ‘শিকড়’টা এমন বলেই হয়তো জানতেন, তিল পরিমাণ সুযোগও হাতছাড়া করা যাবে না। ব্রিসবেনে সিরাজ তাঁর সদ্ব্যবহার করার জন্যই ভারতীয় দল মাঠ ছেড়েছে ‘এক গরিব অটোরিকশাচালকের পরিবার থেকে উঠে আসা পেসার’–এর নেতৃত্বে। ২০১৭ আইপিএল নিলামে সিরাজকে ২ কোটি ৬০ লাখ রুপিতে সানরাইজার্স কেনার পর ঊর্ধ্বকমাযুক্ত অংশটি শিরোনাম হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে।

কিন্তু ক্রিকেট কি ধনী-গরিবের ফারাক বোঝে, বোঝা উচিত? সব পরীক্ষা তো ওই ২২ গজে, যেখানে ভারতীয় পেস আক্রমণের মূল ‘ফলা’ যশপ্রীত বুমরা। সিরাজ যখন মাঠ ছাড়লেন, সবার আগে তাঁকে বুকে টেনে নিয়েছেন এই বুমরাই। মদন লাল থাকলেও হয়তো নিতেন। গ্যাবা চিরকালের পেসবান্ধব। সেখানে ৪৪ বছর আগের টেস্টে ৭২ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ’৮৩ বিশ্বকাপজয়ী। গ্যাবায় ভারতীয় পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিং ফিগার। দ্বিতীয় সেরা সিরাজের ১ রান বেশি দেওয়ার আক্ষেপ হতেই পারে।

তৃতীয় ভারতীয় পেসার হিসেবে গ্যাবায় ইনিংসে ৫ উইকেট পেলেন মোহাম্মদ সিরাজ। প্রথম দুজন মদন লাল (১৯৭৭) ও জহির খান (২০০৩)।

কিন্তু অনভিজ্ঞ এক আক্রমণভাগের নেতৃত্ব দিয়ে, সিডনির দর্শকদের বর্ণবাদী মন্তব্য সহ্য করে সিরাজের এই পারফরম্যান্সকে মদন লাল হয়তো বেশি নম্বর দেবেন।
ভারত ‘এ’ দল থেকে উঠে আসা সিরাজের জন্য আরও এক পক্ষের বেশি নম্বর পাওয়া উচিত। ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অভিভাবকদের। ২০১০ সাল থেকে ভারত ‘এ’ দল ৫২টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে, আর কোনো দেশের ‘এ’ এই সময়ের মধ্যে এত ম্যাচ খেলেনি। সিরাজ এ সময় ‘এ’ দলের হয়ে খেলেছেন ১৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। নবদীপ সাইনি খেলেছেন ১৪টি, হনুমা বিহারি ১২টি। অর্থাৎ বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচে চাপ সামলানোর কায়দাটা তাঁরা ‘হোমওয়ার্ক’-এ ভালোভাবেই শিখেছেন।

ভারতের সাবেক পেসার ইরফান পাঠান তাই সিরাজের পারফরম্যান্সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রসঙ্গ টেনেছেন, ‘প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজেদের নিংড়ে দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিরাজ ও শার্দুলের ক্ষেত্রে বোঝা যায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কত গুরুত্বপূর্ণ। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই অভ্যাস থাকলে টেস্টে স্পেলের পর স্পেল বল করা যায়।’

সিরাজের কপালের ঘামে বল ঘষছেন মায়াঙ্ক আগারওয়াল।
ছবি: এএফপি

গ্যাবায় ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া ভারতীয় বোলার খুব বেশি নেই। ১৯৬৮ সালে স্পিনার এরাপল্লি প্রসন্ন, ১৯৭৭ সালে বিষেন সিং বেদি ও মদন লাল, ২০০৩ সালে জহির খানের ১৮ বছর পর সিরাজ।

ড্রেসিং রুমে অবশ্য এমন একজনকে পাচ্ছেন যিনি সিরাজের মতোই অভিষেক টেস্ট সিরিজে ইনিংসে ৫ উইকেটের দেখা পেয়েছেন। প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী। ১৯৮১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এ তালিকায় বাকি তিন ভারতীয়, মোহাম্মদ নিসার (১৯৩২), বমন কুমার (১৯৬১) ও ভেঙ্কটেশ প্রসাদ (১৯৯৬)।

সিরাজ যখন গত বছর দুবাইয়ে আইপিএল খেলছিলেন, সে সময় তাঁর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু ছেলের বোলিং দেখে তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এসেছিলেন। ক্রিকেটের প্রতি বাবার এই ভালোবাসার দাম এখন পাচ্ছেন সিরাজ। যদিও বাবার কাছ থেকে তাঁর আর কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই। ব্রিসবেন টেস্টের আগে তাঁকে লড়াইয়ের মানসিক প্রেরণাটা নিতে হয়েছে ‘মায়ের সঙ্গে কথা বলে’।
অনন্তলোকের গ্যালারি থেকে তাঁর বাবা নিশ্চয়ই করতালি দিচ্ছেন!