সেই ইংলিশরাই এখন ভারতীয়দের পিছু পিছু ঘোরে

আইপিএলের কারণে ক্রিকেট মাঠে ভারতীয়দের প্রতি বর্ণবাদী আচরণও থেমে গেছে বলে মনে হচ্ছে ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের।ছবি: বিসিসিআই

ওলি রবিনসনের আট বছরের পুরোনো একটা টুইটে সবকিছুর শুরু। ক্রিকেটের সঙ্গে বর্ণবাদ জড়িয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। এশিয়া অঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে ভারতীয়দের ইংলিশরা কীভাবে খাটো করে দেখেছে সব সময়, এ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই আলোচনা।

এ আলোচনায় জড়িয়ে গেছেন ভারতের সাবেক উইকেটকিপার ফারুক ইঞ্জিনিয়ারও। খেলোয়াড়ি জীবনে ইংলিশ কাউন্টিতে খেলা ফারুক ইঞ্জিনিয়ার তুলে ধরেছেন সে সময়ে তাঁর সঙ্গে ইংলিশদের করা বিরূপ আচরণের কথা। পাশাপাশি ইংলিশদের বড় এক খোঁচাই দিলেন। তাঁর কথা, একসময়ে ভারতীয়দের ‘ব্লাডি ইন্ডিয়ান’ বলে অপমান করা ইংলিশরাই এখন আইপিএলের কারণে ভারতীয়দের বেশ তোয়াজ করে চলে।

ফারুক ইঞ্জিনিয়ার খোঁচা মেরেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকেও। আট বছরের পুরোনো বর্ণবাদী টুইটের কারণে রবিনসনকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। কিন্তু পুরোনো টুইটের কারণে এভাবে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আবার কথা বলেছেন বরিস জনসন। ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের চোখে, একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসনের এভাবে কথা বলাটা ছিল ‘জঘন্য’।

ফারুক ইঞ্জিনিয়ার।
ছবি: সংগৃহীত

গত রোববার শেষ হওয়া লর্ডস টেস্টে অভিষেক হয় ২৭ বছর বয়সী রবিনসনের, কিন্তু সে সময় আলোচনায় চলে আসে আট বছর আগে তাঁর করা বর্ণবাদী কয়েকটি টুইট। তদন্ত শুরু হয়। এর জেরে এক টেস্ট খেলতে না খেলতেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেন রবিনসন। নিষেধাজ্ঞা চলবে তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত। তদন্ত শেষে অন্য শাস্তি এলে তখন সেটিও ভোগ করতে হবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে ৭ উইকেট নেওয়া ইংলিশ পেসারকে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এ ক্ষেত্রে রবিনসনের পাশে দাঁড়ানোয় বেশ বিস্মিত হয়েছেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকেই ভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে ফারুক ইঞ্জিনিয়ার বলেছেন, ‘বরিস জনসনের কথাগুলো পত্রপত্রিকায় পড়ছি। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এমন বিবৃতিতে নিজের নাম জড়ানো আমার চোখে খুবই জঘন্য হয়েছে। ছেলেটার (রবিনসন) শাস্তি পাওয়াই উচিত।’

রবিনসনের বর্ণবাদী টুইটের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) ভূমিকার প্রশংসাও করেছেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, ‘আমার মনে হয়, ওকে নিষিদ্ধ করে ইসিবি একেবারে ঠিক কাজটি করেছে। ওর বিবেচনায় ভুল হয়েছে, সেটার মূল্য ওকে দিতে হবে। এটা অন্যদের এমন কিছু করতে নিরুৎসাহিত করবে।’

ইংল্যান্ড পেসার ওলি রবিনসন।
ফাইল ছবি: এএফপি

টুইট করার সময় রবিনসনের বয়স মাত্র ১৮ বছর ছিল, এতে তাঁর অপরাধকে খাটো করে দেখছেন না ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, ‘যখন কেউ বলে ওর বয়স তো তখন ১৮ ছিল, এত খারাপ লাগে! এই বয়সেই তো একজন মানুষ দায়িত্ব নিতে শেখে। (বয়সের কারণে) যদি ক্রিকেটাররা ছাড় পেয়ে যায়, তাহলে আরও খারাপ হবে। মানুষ আমাদের (এশিয়ান) উদ্দেশে যা খুশি তা-ই বলার সুযোগ পাবে। এটাকে শুরুতেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমি তো বলছি না ওকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হোক। তবে বড় আর্থিক জরিমানা করা হোক, যাতে তাদের পকেটে টান পড়ে বা ওকে টেস্টে একটা সিরিজে বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা যায়। এটাতে কঠোর হতেই হবে।’

খেলোয়াড়ি জীবনে ইংলিশ কাউন্টিতে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে খেলেছেন বর্তমানে ৮৩ বছর বয়সী ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের হয়ে ৪৬ টেস্ট খেলা উইকেটকিপার সে সময়ের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, ‘যখন আমি কাউন্টি ক্রিকেটে এসেছিলাম, প্রশ্ন শুনতে হতো, “ও ভারত থেকে এসেছে!” ল্যাঙ্কাশায়ারে আসার পর আমাকে এক-দুবার বর্ণবাদী মন্তব্যও শুনতে হয়েছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করা কিছু নয়, শুধু আমি ভারতীয় বলেই এসব শুনতে হয়েছে। আমার কথা বলার ধরন নিয়ে খোঁটা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এসব বলা হতো।’

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট সব সময় ভারতীয়দের উদ্দেশে ‘ব্লাডি ইন্ডিয়ানস’ বলতেন বলে কদিন আগে এক পডকাস্টে (অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান) বলেছিলেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার।

ভারতীয়দের ইংরেজিজ্ঞান এবং ইংরেজি বলার ঢং নিয়ে ইংলিশদের হাসি-কৌতুক অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের দাবি, ‘সত্যি বলতে, আমার ইংরেজির দক্ষতা অনেক ইংলিশের চেয়েও ভালো। তাই তখন (ল্যাঙ্কাশায়ারে খেলার সময়ে) দ্রতই ওরা বুঝে গিয়েছিল, ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ঝামেলা করে লাভ নেই। আমি ওদের সঙ্গে সঙ্গেই কথা শুনিয়ে দিতাম। শুধু তা-ই নয়, আমি ব্যাট ও গ্লাভস হাতেও নিজেকে প্রমাণ করেছি।’

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট সব সময় ভারতীয়দের উদ্দেশে ‘ব্লাডি ইন্ডিয়ানস’ বলতেন বলে কদিন আগে এক পডকাস্টে (অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠান) বলেছিলেন ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। শুধু বয়কটই নন, অন্য ইংলিশদের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ানরাও এমনটা বলতেন বলে দাবি করেছেন সাবেক ভারতীয় উইকেটকিপার।

কিন্তু আইপিএল আসার পর এখন পরিস্থিতি পুরো ১৮০ ডিগ্রি বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের, ‘কয়েক বছর আগেও আমরা সবাই ওদের কাছে “ব্লাডি ইন্ডিয়ানস” ছিলাম। আইপিএল শুরু হওয়ার পর থেকে ওরা আমাদের তোয়াজ করে চলছে। আমার ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে শুধু টাকার জন্য ওরা এখন আমাদের পিছু পিছু ঘোরে।’

এর সঙ্গে পুরোনো সময়ের চিত্র মিলিয়ে ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের উষ্মা, ‘আমার মতো যারা আছে, তারা জানে যে ওদের আসল রূপটা কী ছিল। এখন হঠাৎ ওদের সুর বদলে গেছে। ভারত এখন ওদের কাছে এমন একটা দেশ, যেখানে গিয়ে (আইপিএলের সময়ে) কয়েক মাস ধরে টিভিতে কাজ করা যায় বা খেলা যায়।’