সেই সব সুখস্মৃতি

চট্টগ্রামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্টে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন মুমিনুল হক।ছবি: প্রথম আলো

ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই একটা সময় ছিল শুধু আতঙ্ক। কানের পাশ দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে চলে যাচ্ছে গতিময় বল। মাথার ওপর ফনা তুলছে বাউন্সার। যখন বোলিং প্রান্তে, উল্টো দিকে শিবনারায়ণ চন্দরপলের ক্লান্তি ধরানো ব্যাটিং ক্রমে গড়িয়ে চলেছে ডাবল সেঞ্চুরির দিকে। অথবা ক্রিস গেইলের মতো কারও ঝোড়ো তাণ্ডবে নুয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

সময় কখনো কখনো উল্টো স্রোতেও চলেছে। ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজই বলুন কিংবা ২০০৯ সালের ফ্লয়েড রেইফারের ভাঙাচুরা ক্যারিবীয় দল, তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশেরও আছে কিছু সুখস্মৃতি। সেসবের কোনোটি হঠাৎ পাওয়া, কোনো কোনোটি এসেছে প্রত্যাশিতভাবেই। কাল থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আরও একটি টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে চলুন ফিরে দেখা যাক সেই সব সুখস্মৃতির দিকে—

অলকের ফিফটি

২০০২ সালের ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ দল। ক্রিস গেইল, রামনরেশ সারোয়ান, শিবনারায়ণ চন্দরপল, পেদ্রো কলিন্স, ড্যারেন পাওয়েল, জার্মেইন লসনদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাত্রই দুই বছর হলো টেস্ট খেলতে শুরু করা বাংলাদেশ তখনো ক্রিকেটের এই সংস্করণে নবীন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট খেলাটাই তখন বাংলাদেশের মতো একটা দলের জন্য অনেক।

টেস্টে অলক কাপালির দুটি ফিফটিই ২০০২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
ফাইল ছবি

যেকোনো প্রথম উপলক্ষের সব প্রথমই বিশেষ কিছুর মর্যাদা পায়। মাত্র ১৩৯ রানে শেষ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে অলক কাপালির ৫২ রানের ইনিংসটিও সে রকমই এক ‘বিশেষ’। ক্যারিবীয় পেস আক্রমণের সামনে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সেটি ছিল প্রথম ফিফটি, যেটি কিনা দলের সবাই মিলে করা রানেরই প্রায় অর্ধেক। ৮৬ বলে ফিফটি করার পর আর ২ রান যোগ করে ভ্যাসবার্ট ড্রেকসের বলে এলবিডব্লু হয়ে গিয়েছিলেন অলক।

১৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে অলকের দুটি ফিফটিই ছিল সেই সিরিজে। চট্টগ্রামের পরের টেস্টে ৮৫ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলেও প্রথম ফিফটিটা নিশ্চয়ই অলকের কাছেও আলাদা হয়ে আছে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেই টেস্ট হয়তো ভুলেই যেতে চাইবে বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৭ রানে অলআউট হয়ে যে টেস্ট বাংলাদেশ হেরেছিল ইনিংস ও ৩১০ রানের বিশাল ব্যবধানে! এতটাই বিশাল যে রানের ব্যবধানে টেস্টে এখনো সেটিই বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় হার।

সেন্ট লুসিয়ায় জয়ের সমান ড্র

সেন্ট লুসিয়ায় সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ ও মোহাম্মদ রফিক।
ফাইল ছবি

এক টেস্টে তিন সেঞ্চুরি, যার দুটিই আবার প্রথম ইনিংসে। ২০০৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ দল স্বপ্নের মতোই এক টেস্ট খেলল সেন্ট লুসিয়ায়। অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের ১১৩, মোহাম্মদ রফিকের ১১১ ও মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮১ রানের সৌজন্যে প্রথম ইনিংসে ৪১৬ রান করে বাংলাদেশ দল। অভিষেক টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ৪০০ রান করার পর সেবারই প্রথম ৪০০ রানের দেখা পায় বাংলাদেশের ইনিংস।

ক্রিস গেইলের সেঞ্চুরির পরও ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম ইনিংসে ৩৫২ রানে আটকে রেখে ৬৪ রানের লিড। দ্বিতীয় ইনিংসে খালেদ মাসুদের অপরাজিত ১০৩ রানের সৌজন্যে ৯ উইকেটে ২৭১ রান করে ইনিংস ঘোষণা, ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে তাদেরই মাটিতে রীতিমতো দাপট দেখিয়েই টেস্টটা ড্র করে বাংলাদেশ দল। টেস্টে এর আগে বাংলাদেশ দলের সাফল্য বলতে ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুটি ড্র। একটি ঘরের মাঠে, আরেকটি জিম্বাবুয়েতে গিয়ে। বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাবের দ্বিতীয় ড্রয়ের ঠিক পরের সিরিজেই আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই ড্র, যেটি বাংলাদেশ দলকে দিয়েছিল জয়ের সমান আনন্দ।

অনেক প্রাপ্তির ২০০৯

ক্রিকেটারদের বিদ্রোহে সেবার ক্যারিবীয় দলটা হয়ে পড়েছিল নড়বড়ে। নিয়মিত ক্রিকেটাররা নেই, ফ্লয়েড রেইফারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুখোমুখি হলো দুর্বল এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুই টেস্টেই জিতে বাংলাদেশের করা প্রথম হোয়াইটওয়াশের সাফল্যটাকে তাই অনেকেই বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, ওই দলের অনেকেই পরে পারফরম্যান্স দিয়েই জায়গা করে নিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে। ড্যারেন স্যামি পরে অধিনায়ক হয়েছেন। কেমার রোচ, টিনো বেস্টরাও খেলে গেছেন দাপটের সঙ্গে।

সেন্ট ভিনসেন্টের প্রথম টেস্টেই চোট পেয়ে সিরিজ থেকে ছিটকে পড়েন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। নেতৃত্বে আসেন সাকিব আল হাসান। তাঁর নেতৃত্বেই ৯৫ রানে প্রথম টেস্ট জেতে বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যান অব দ্য ম্যাচ তামিম ইকবালের সেঞ্চুরি আর মাহমুদউল্লাহর ৫১ রানে ৫ উইকেটের বড় অবদান ছিল তাতে।

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সিরিজসেরা হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান।
ফাইল ছবি

গ্রেনাডায় পরের টেস্টটা বাংলাদেশ দল চার দিনেই জিতে যায় ৪ উইকেটে, যে জয় প্রথম হোয়াইটওয়াশ করার স্বাদও এনে দেয় সাকিবের দলকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মোট ৮ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতেও করেন অপরাজিত ৯৬ রান। টেস্টটাতে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন সাকিব। ম্যান অব দ্য সিরিজও হয়েছেন তিনিই।

বাঁহাতি স্পিনে আসা এক ড্র

বাংলাদেশের স্পিনের সামনে বরাবরই অস্বস্তিতে ভোগেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা। ২০১১ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেও বাঁহাতি স্পিনের সামনেই কুপোকাত ড্যারেন স্যামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবালের ফিফটিতে প্রথম ইনিংসে ৩৫০ রান করে বাংলাদেশ দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৪৪ রানে থামিয়ে দিয়ে তাতেই আসে ১০৬ রানের লিড।

দুই বাঁহাতি স্পিনার ইলিয়াস সানি আর সাকিব আল হাসানের সামনে আসলে দাঁড়াতেই পারেননি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা। ৯৪ রানে ৬ উইকেট নেওয়া ইলিয়াসের তো ওটাই ছিল অভিষেক টেস্ট! ৫৩ রান দিয়ে সাকিবের উইকেট ছিল ৩টি। প্রথম ইনিংসেই ১০৬ রানে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেটে ১১৯ রান করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানায়। ২২৬ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২ উইকেটে ১০০ রান করার পরই শেষ হয়ে যায় খেলা। এই ইনিংসেও তাদের দুটি উইকেট ভাগাভাগি করে নেন দুই বাঁহাতি সাকিব ও ইলিয়াস।

আবার হোয়াইটওয়াশ

টেস্ট অভিষেকে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন নাঈম হাসান।
ফাইল ছবি

২০১৮ সালের হোম সিরিজে যেন ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে খেলা সিরিজটাই ফিরিয়ে আনল বাংলাদেশ দল! আবার দুই টেস্টের সিরিজ, আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল হলো হোয়াইটওয়াশ।

চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তিন দিনেই শেষ হয়ে যাওয়া টেস্টের প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হকের সেঞ্চুরির সৌজন্যে ৩২০ রান করে বাংলাদেশ দল। খুব বেশি রান হয়তো ছিল না, তবু নিজেদের প্রথম ইনিংসে সেই রানও অতিক্রম করতে পারেনি সফরকারীরা। ৫ উইকেট নিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ান অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা অফ স্পিনার নাঈম হাসান।

দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশকে মাত্র ১২৫ রানে অলআউট করে দিয়ে যেন ফিরে আসার ঘোষণা দিতে চাইলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা। কিন্তু বাংলাদেশের বোলিংটাও যে হলো বিধ্বংসী! বাংলাদেশের স্পিন ঘূর্ণিতে আবারও লন্ডভন্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিন স্পিনার তাইজুল ইসলাম, সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজ মিলে ১৩৯ রানেই শেষ করে দেন ক্যারিবীয়দের ইনিংস। ৩৩ রানে তাইজুলের একারই ৬ উইকেট, ২ উইকেট করে নেন সাকিব ও মিরাজ।