সেদিন আগুন লেগেছিল যুবরাজের সলতেয়

যুবরাজের ছয় ছক্কার একটি।
ছবি: এএফপি

জীবনে চলার পথে এমন কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের চেতনায় গাঢ় ছাপ রেখে যায়, যা বিস্মৃত হতে চাইলেও পারা যায় না। বার বার ফিরে আসে স্মৃতির চেনা পথ ধরে, টেনে নিয়ে যায় পেছনে...দূরে বহু দূরে। তখন ‘সময় কত দ্রুত বয়ে যায়’—কথাটা মনে হয় মনের ভ্রান্ত অনুভূতি। যুবরাজ সিং ও স্টুয়ার্ট ব্রডের কি আজ এমন মনে হচ্ছে?

এ দুটি নাম উচ্চারিত হলেই যে স্মৃতিটা ফিরে আসে, হ্যাঁ সেটার কথাই বলা হচ্ছে। একই সময়ে দু–রকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল দুই ক্রিকেটারের। দুজনের কেউ–ই তা ভুলতে পারবেন না। ওই সময়ে টিভিতে বা গ্যালারিতে যাঁরা ছিলেন—তাঁরাও কি ভুলতে পারবেন? ক্রিকেটে এমন দৃশ্য দেখা যায় কালেভদ্রে, যেখানে একজনকে মেনে নিতে হয়েছিল সেই অমোঘ রসিকতা—চরম বিপর্যয় মুখ টিপে হেসে সহ্য করাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্টুয়ার্ট ব্রডের মুখে অসহায়ত্ব নির্ণায়ক সেই হাসি নিশ্চয়ই মনে আছে? আর যুবরাজ? হাতের উইলোকে তুলি বানিয়ে ব্রডের মুখখানা বানিয়েছিলেন ক্যানভাস, এঁকেছিলেন ইচ্ছেমতো। দুঃখিত, পড়ুন মেরেছিলেন ইচ্ছেমতো!

অথচ ব্রডের কোনো দোষই ছিল না। দায় শুধু তাঁর বল করার। ক্রিকেটে আইনের মারপ্যাঁচে তখন তাঁকে বল করতে হয়েছিল, যখন যুবরাজের চোখে আগুন, রক্ত টগবগ করে ফুটছে শরীরে। আগের ওভারে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ খেপিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন তাঁর গলা কেটে নিতে চান! এমন কথা শোনার পর কার–ই বা মাথা ঠিক থাকে। জ্ঞানশূন্য অথচ ক্রিকেটীয় কৌশলে ওই সময়টাই যুবরাজের জন্য হয়ে গিয়েছিল ‘জোন’—ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে এই শব্দটা বোঝানো হয় সেই সময়কে, যখন তিনি শুধু বলটাই দেখেন আর সবকিছু লাগে মাঝ ব্যাটে। মনে পড়ে ১৩ বছর আগে ডারবানের সেই ছয় ছক্কাকে?

ব্রডের মন পোড়ার কথা। ফ্লিনটফ হয়তো আজ মিটিমিটি হাসছেন। ভারতীয় ক্রিকেটে সেই সময়ের যুবরাজ–বিস্ফোরণের নেপথ্য সলতে যে ছিলেন ‘ফ্রেডি’। সেটা ছিল প্রথম টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ডারবানে মুখোমুখি ইংল্যান্ড–ভারত। ব্রড ছয় ছক্কা হজম করেছিলেন ১৯তম ওভারে। তার আগের ওভারটা করেছিলেন ফ্লিনটফ। ইউটিউবে ম্যাচটির হাইলাইটস দেখলে বুঝবেন, ওই ওভার শেষে ফ্রেডির সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে লেগেছিল যুবরাজের। পেছাতে পেছাতে যুবরাজকে কিছু একটা বলছিলেন সাবেক ইংলিশ অলরাউন্ডার। আর যুবরাজ বিস্ফোরিত নেত্রে ব্যাটটা দেখিয়ে জবাব দিচ্ছিলেন, দু কদম হেঁটে এগিয়েও গিয়েছিলেন। তৎক্ষনাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হয়তো বুঝেছিলেন, জবাব দেওয়ার জায়গা তো ওটা নয়—বাইশ গজের ক্রিজ তাহলে কীসের জন্য!

ছয় ছক্কা কোনটি কোন দিকে?
ছবি: সংগৃহীত

স্টুয়ার্ট ব্রড তখন ২১ বছরের টগবগে পেসার। আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটেছে এক বছর আগে। সোনালি চুলের ছেলেটির চোখেমুখে আত্মবিশ্বাস। প্রথম বলটাই করলেন...নাহ, এসব আরও পরেও বলা যাবে। ওই ছয়টা বল আর কোনটা কোথায় গিয়ে পড়েছিল—সে তো অনেকেরই মুখস্থ কিংবা ঠোটস্থ! সলতেয় আগুন ধরার কাহিনীটা আগে বলাই ভালো।

ওই ম্যাচের কয়েক সপ্তাহ আগে ওয়ানডে ম্যাচে যুবরাজকে পাঁচ ছক্কা মেরেছিলেন ইংল্যান্ডের দিমিত্রি মাসকারেনহাস। ফ্রেডি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যুবরাজের এই ক্ষতটা সেদিন ‘জীবন্ত’ করে তোলেন। কীভাবে? শুনুন যুবরাজের মুখেই, ‘ফ্রেডি দুটো ভালো বল করেছিল,এর মধ্যে একটা ছিল ইয়র্কার—আমি ওটা বাউন্ডারি মারি। তার ভাবখানা ছিল এটা কোনো শটই না, সে বলল তোমার গলা কেটে নেব। জবাব দিয়েছিলাম, ব্যাটটা দেখেছ? এটা দিয়ে তোমাকে মেরে কোথায় পাঠাব, জানো? মনে পড়ে, ব্রডকে ছয় ছক্কা মারার সময় ভীষণ রাগ হয়েছিল। একবার মাসকারেনহাস আরেকবার ফ্লিনটফের দিকে তাকাচ্ছিলাম।’

বাংলায় একটা কথা আছে ‘তাওয়া গরম থাকতে থাকতে ভেজে ফেলা উচিত’—শেষ ওভারে ফ্লিনটফ বল করতে আসবেন কি না, যুবরাজ সে অপেক্ষায় আর থাকেননি। পরের ওভারে ব্রডকেই ভেজে ফেললেন বাইশ গজের তাওয়ায়—প্রথমটা মিডউইকেট দিয়ে মাঠের বাইরে, পরেরটা পায়ের পাতার সামনে থেকে করা ফ্লিকে গ্যালারিতে, তৃতীয়টা ভাসল এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে—সেই গ্যালারিতেই। সমূহ বিপদ বুঝে ব্রড এরপর দৌড়ের প্রান্ত বদল করেন। এবার রাউন্ড দ্য উইকেট। কিন্তু বলটা ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে ফুল টস। যুবরাজের নমনীয় কবজি তা পাঠাল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের গ্যালারিতে। দর্শকদের কেউ হতভম্ব, কারও মধ্যে চিত্ত–চাঞ্চল্য, ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠে উত্তেজনা। কিছু একটা ঘটতে চলেছে! ব্রডের পঞ্চম বলটা মিডউইকেট দিয়ে আকাশে তুললেন যুবরাজ। আউট? নাহ, এবারও সীমানার ওপারে। শেষ বলটা যুবরাজের ব্যাট থেকে মিড অন বরাবর ভেসে যেতেই সবাই বুঝে গিয়েছিল ওটা ছক্কা!

আরেকটা রেকর্ডও এল হাত ধরে। ওই ওভারের আগে যুবরাজের রান ছিল ১৪, ওভার শেষে ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন ফিফটির উদযাপনে। কী সদর্প উদ্‌যাপন, কী দাপুটে ফিফটি। যুবরাজের ইনিংসের স্থায়িত্ব তখন মাত্র ১২ বল। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আজও দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড সেটি। আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া—সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টিতেও রেকর্ড, তবে সেখানে আরও দুজন সঙ্গী আছে যুবরাজের। মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে বিগ ব্যাশে ক্রিস গেইল আর কাবুল জোয়ানানের হয়ে আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগে হযরতউল্লাহ জাজাই-ও ফিফটি করেছিলেন ১২ বলে।

যুবরাজের ওই ইনিংসের পর এরপর কেটে গেল ১৩ বছর। এ সময়ের মধ্যে ব্রডকে নিয়ে রসিকতা কম হয়নি। প্রতিবারই ঢাল হয়ে হাজির হয়েছেন যু্বরাজ। তবু লোকে থামেনি। যুবরাজের ওই ছয় ছক্কার পর ভারতে রীতিমতো ‘সেলেব্রিটি’ হয়ে গিয়েছিলেন ফ্লিনটফ–ব্রড, টিভিতে ও বিজ্ঞাপনে। যুবরাজ আজ সেই ঘটনা স্মরণ করে ছবিসহ একটা পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রামে, ‘১৩ বছর! সময় কত দ্রুত বয়ে যায়!’ স্বাভাবিকভাবেই ব্রডেরও সেই স্মৃতি মনে পড়ার কথা। যুবরাজের পোস্টে ইংলিশ পেসার লিখেছেন, ‘সেদিন রাতে সময়ের চেয়ে বলের ওড়ার গতি বেশি ছিল’—সঙ্গে একটি রকেট ইমোজি।

ব্রড ভুল বলেননি। সেদিন যুবরাজের ব্যাট থেকে গ্যালারির পানে ছুটে যাওয়া বলের গতি সময়ের চেয়ে বেশি ছিল বলেই, আজ সেই ঘটনার ১৩ বছর পূর্তির দিনে মনে হয়—এ তো সেদিনের কথা, তরতাজা স্মৃতি!