সেদিন মায়ের ভরসা না পেলে ক্রিকেটই ছেড়ে দিতেন রশিদ

রশিদ খান—লেগ স্পিন শিল্পে সময়ের অন্যতম সেরা শিল্পীছবি: আইপিএল

রশিদ খানের তৃতীয় ওভারটা তখন শেষ হয়েছে। তাঁকে ট্যাগ করে ভারতীয় ধারাভাষ্যকার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক হার্শা ভোগলের টুইট, ‘একটা কথাই বলতে পারি—সেরা! লক্ষ্য ২২০ রান, তাতে ৩ ওভারে ৬ রানে ২ উইকেট! চ্যাম্পিয়ন!’

আইপিএলে কাল দিল্লি ক্যাপিট্যালসের বিপক্ষে নিজের শেষ ওভারেও সেই ‘সেরা’ ছন্দ ধরে রেখেছেন রশিদ। ১ রান দিয়েছেন আফগানিস্তান লেগ স্পিনার, উইকেট নিয়েছেন আরেকটি। দিল্লিকে ২১৯ রানের লক্ষ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ৮৮ রানে জিতেছে রশিদের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ।

উইকেট পাওয়ার উচ্ছ্বাস রশিদের—এবারের আইপিএল ১২ ম্যাচে এমন উচ্ছ্বাস দেখেছে ১৭ বার।
ছবি: আইপিএল

কিন্তু আইপিএলে আলো ছড়ানো তো দূরে থাক, ক্রিকেট মাঠেই এই রশিদ খান নামটা হয়তো কেউ চিনত না—যদি না সেদিন ফোনে ভরসা পেতেন আফগান লেগ স্পিনার। ফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন রশিদের মা।

এখন আর সরাসরি তো কথা হয়ই-না, ফোনেও আর মায়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় না রশিদের। কীভাবে বলবেন, মা যে অন্যলোকে! দীর্ঘদিন রোগশোকে ভোগান্তির শেষ টেনে গত জুনে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান রশিদের মা। তাঁকে কতটা মনে পড়ে রশিদের, সেটি সম্ভবত এখন কারও অজানা নয়। এই তো, গত ৩০ সেপ্টেম্বর এই দিল্লি ক্যাপিট্যালসের বিপক্ষে ম্যাচের পরও মা-কে স্মরণ করেছিলেন রশিদ।

সেদিনও দারুণ বোলিংয়ে ১৪ রানে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন রশিদ, মৌসুমে প্রথম জয়টা এনে দিয়েছিলেন হায়দরাবাদকে। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে কথা বলতে গিয়েই গলা ধরে আসছিল সেদিন রশিদের। বলছিলেন, ‘খুব কঠিন দেড়টা বছর কেটেছে আমার। প্রথমে বাবা মারা গেলেন, এরপর মা। আমার মা-ই আমার সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন। বিশেষ করে আইপিএলে যখন আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতাম, রাতভর মা আমার সঙ্গে কথা বলতেন।’

ক্রিকেট খেলতে বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘুরতে হয় বলে মায়ের সঙ্গে নিয়মিত দেখা তো হতো না, তবে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময়গুলো রশিদের কাছে ছিল মধুর। রশিদের জীবনও পাল্টে দিয়েছিল এমন এক ফোনকল। কাল আরেকবার দিল্লি ক্যাপিট্যালসের বিপক্ষে ম্যাচসেরা রশিদ খেলার পর এক ভিডিওতে জানাচ্ছিলেন সে গল্প। তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে খ্যাতি দূরে থাক, আফগানিস্তান জাতীয় দলেই ডাক পাননি রশিদ। বরং, কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেয়ে আফগানিস্তান-এ দল থেকে বাদ পড়ার পর ক্রিকেটই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন রশিদ।

‘আফগানিস্তান-এ দলে ডাক পেয়েছিলাম তখন, ক্যাম্পে যোগও দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো ম্যাচে খেলার সুযোগ পাইনি। এরপর দল থেকে বাদ পড়ে গেলাম। ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম তখন। আমার ভাই-ও খুব রেগে গিয়েছিল, আমাকে বলছিল ‘‘তুমি ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দাও!’’—সানরাইজার্স হায়দরাবাদের টুইটারে প্রকাশিত ভিডিওতে নিজের ক্রিকেটযাত্রার গল্পে বলছিলেন রশিদ।

তা ক্রিকেট ছাড়ার চিন্তা যাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেই রশিদই চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে আরও উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন ক্রিকেটে। রশিদ খানের মা-কে সে জন্য ধন্যবাদ দেবে ক্রিকেট। গল্পটা বলছিলেন রশিদ, ‘এরপর আমি মা-র সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘‘তুমি শুধু খেলাটা উপভোগ করো।’’ ফল যা-ই হোক না কেন! তুমি যদি আগামীকালই দলে সুযোগ না পাও, না পেলে! কোনো না কোনো এক দিন পাবে।’

এরপরের গল্পটা? আফগানিস্তান-এ দল থেকে বাদ পড়া রশিদ ফিরে গেলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, তবে সেবারের ফেরায় চোয়ালটা আরেকটু শক্ত করে বাঁধা ছিল প্রতিজ্ঞায়। মায়ের স্নেহমাখা কণ্ঠ যেন এসেছিল রশিদের আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি হয়ে। ফল? রশিদের কণ্ঠেই জেনে নিন, ‘ঘরোয়া একটা টুর্নামেন্ট চলছিল, সেখানে তিন ম্যাচে ২১ উইকেট পেয়েছিলাম। আর সেখানে পারফরম করার পর ২০১৫ সালে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে গেলাম।’

সে বছরের অক্টোবরে বুলাওয়েতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে অভিষেকের পর রশিদের ক্রিকেটযাত্রা আরও ৭০টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে দেখেছে। টি-টোয়েন্টি দেখেছে ৪৮টি। আর টেস্ট চারটি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে উইকেটের উচ্ছ্বাসে রশিদ মেতেছেন ২৪৫ বার। শুধু কি আন্তর্জাতিক মঞ্চ? ক্রিকেট দুনিয়ার হেন কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আছে যেখানে রশিদের কদর নেই? বরং প্রশ্ন এখন হয় এ নিয়ে যে, ২২ বছর বয়সী আফগানই কি এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা লেগ স্পিনার কি না?

অন্যলোকে বসে আরেকজন এ প্রশ্নে উত্তর হয়তো দিতে পারছেন না, তবে প্রশ্নটা শুনে গর্বে তাঁর চোখে জল আসে নিশ্চিত। প্রশ্নটার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হবে, এই আত্মবিশ্বাস হয়তো অনেক বছর আগে ফোন কলের সময়ই ছিল তাঁর। রশিদ খান যে তাঁরই নাড়িছেঁড়া!