স্টিভ স্মিথ হতে পারেননি সাকিব

স্মিথ হতে পারলেন না সাকিব।ছবি: শামসুল হক

জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আজ ফিরে আসতে পারত এজবাস্টন। ২০১৯ সালের ১ আগস্ট যে উদ্‌যাপনটা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ স্মিথ; হেলমেট খুলে, ব্যাট উঁচিয়ে প্রত্যাবর্তন টেস্টে সেটাই আজ করতে পারতেন বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান। কিন্তু হলো না।

সাকিবের জন্য মঞ্চটা প্রস্তুতই ছিল। চট্টগ্রামের উইকেটে ব্যাটিং করাটা কঠিন কিছু মনে হচ্ছিল না দ্বিতীয় দিন সকালেও। প্রথম দিন শেষে ৩৯ রানে অপরাজিত থাকা সাকিবের ব্যাটিং এদিনও এতটাই নিয়ন্ত্রিত ছিল যে মনেই হয়নি তিনি টেস্ট খেলতে নেমেছেন প্রায় দেড় বছর পর।

সকাল থেকেই যেন লম্বা ইনিংসে চোখ সাকিবের। জোমেল ওয়ারিক্যান আর শ্যানন গ্যাব্রিয়েলকে সামলে দিনের ষষ্ঠ ওভারে পৌঁছে যান টেস্টে নিজের ২৫তম ফিফটিতে। উইকেট যেহেতু তখনো বোলারদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছিল না, সাকিব যেন ধরতে পেরেছিলেন বড় ইনিংস খেলার সূত্রটা—তাড়াহুড়োয় ভুল না করে উইকেটে যত বেশি সম্ভব সময় কাটাতে হবে। তিনি যে সে পথেই হাঁটছিলেন, তা তো স্কোরকার্ড দেখলেও কিছুটা বোঝা যায়।

আজ ২৯ রান যোগ করতে যে ৫৮ বল খেলেছেন, তাতে বাউন্ডারি মারার চেষ্টাই করেছেন কেবল একবার। মিড অফ আর এক্সট্রা কাভারের মাঝ দিয়ে ৪৯-এ পৌঁছে যাওয়া সে বাউন্ডারিতেও ফুটে উঠেছে হাতের ব্যাটটাকে কথা শোনাতে পারার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস।

লিটন দাস সকাল সকাল আউট হয়ে গেলেও অপর প্রান্তে মেহেদী হাসান মিরাজের পরিণত ব্যাটিংও নিশ্চয়ই আশা দেখাচ্ছিল তাঁকে। লম্বা ইনিংস তো আর একা একা খেলা যায় না। চাই লম্বা সময়ের সঙ্গী।

কিন্তু রাকিম কর্নওয়ালের ওই বলটাতে ঠিক কী করতে চাইলেন সাকিব নিজেও কি তা জানেন? আর ৫-৬ ওভার পরই লাঞ্চ–বিরতি পড়বে। ঠিক ওই সময় কর্নওয়ালের অফ স্টাম্পের বাইরের একটা বল বাড়তি বাউন্স পেল। কিন্তু সাকিব একেবারে শেষ মুহূর্তে যেটা করলেন, সেটা আসলে কী ছিল!

বড় ইনিংস খেলার সূত্রটা পেয়ে গিয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু কোত্থেকে কী যেন হয়ে গেল
ছবি: শামসুল হক

ব্যাটটা হঠাৎই নিচ থেকে ওপরের দিকে তুলে যেন ক্যাচ প্র্যাকটিসই করাতে চাইলেন পয়েন্টে দাঁড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ক্রেইগ ব্রাফেটকে। সহজ ক্যাচটা নিতে ব্রাফেটের তেমন সমস্যাই হয়নি।

হতাশায় ব্যাটে একটা মৃদু ঝাঁকি দিয়ে ড্রেসিংরুমের পথে হাঁটলেন সাকিব। অথচ ইনিংসের শুরু থেকেই যে আত্মবিশ্বাস আর নিয়ন্ত্রণ দেখা যাচ্ছিল তাঁর ব্যাটে, চট্টগ্রামে আজ বার্মিংহামের দিনটা ফিরে আসতেই পারত। স্মিথের সেঞ্চুরির মালাটা পরতে পারতেন সাকিবও।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে টেস্টে সাকিবের প্রত্যাবর্তনটা হলো আইসিসির এক বছরের বহিষ্কারাদেশের শাস্তি কাটানোর পর। সাকিবের অপরাধ ছিল, বাজিকরের কাছ থেকে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানানো।

স্মিথও খেলায় ফিরেছিলেন সাকিবের মতোই এক বছরের সাজা খেটে। মাঠে ফেরার দিন হিসাব করলে সাকিবের মতো তিনিও অ্যাশেজের সেই এজবাস্টন টেস্টটা খেলতে নেমেছিলেন আসলে প্রায় দেড় বছর পর। অমিল শুধু অপরাধে।

স্মিথকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এক বছরের জন্য বহিষ্কার করেছিল বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে। ২০১৮ সালের মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেপটাউন টেস্টে তাঁর সিরিশ কাগজ দিয়ে বল ঘষার ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসেই এক বড় কলঙ্ক হয়ে আছে।

কিন্তু বড় তারকারা বোধ হয় নিজের ভুলকেও ভুলিয়ে দেন অবিশ্বাস্য কীর্তিতে, যেটা এজবাস্টনে করেছিলেন স্মিথ। অ্যাশেজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে যখন অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল, তখনই দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন লম্বা বিরতির পর টেস্টে ফেরা স্মিথ।

নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার ম্যাচ রাঙিয়ে দিয়েছিলেন স্টিভ স্মিথ
ফাইল ছবি: এএফপি

অন্য প্রান্তে অবশ্য তখনো বিপর্যয়ে বাঁধ দেওয়া যায়নি। ১২২ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে বড় লজ্জার দিকে অস্ট্রেলিয়া। পিটার সিডলের সঙ্গে সেখান থেকেই হলো স্মিথের ৮৮ রানের নবম উইকেট জুটি। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ২৮৪ রানের ভীত হলো শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়া স্মিথের ১৪৪ রানের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনই।

অবশ্য এতেই যদি ‘রাজকীয়’ বিশেষণটা ব্যবহার করে ফেলা হয়, তাহলে বাকিটুকুর জন্য কী বলবেন? স্মিথ সেঞ্চুরি করেছিলেন (১৪২) সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও। আর তাতে বল টেম্পারিংয়ের কলঙ্ক মোচন করে তাঁর ফেরাটা হলো আরও বর্ণাঢ্য। স্মিথের প্রত্যাবর্তন উৎসব আরও পরিপূর্ণতা পায়, যখন এজবাস্টন টেস্টটাই অস্ট্রেলিয়া জিতে যায় ২৫১ রানের বিশাল ব্যবধানে।

ইংল্যান্ডের পেসারদের সামনে স্মিথের ফেরার শুরুটা যে রকম ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ছিল, সাকিবের তা ছিল না। কাল যখন তিনি উইকেটে আসেন, ততক্ষণে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ৪ উইকেটে ১৩৪ রান।

ড্রেসিংরুম থেকে উইকেটের ভাষাও ততক্ষণে তিনি বুঝে ফেলেছেন। লিটনের সঙ্গে ৪৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দিন শেষ করে দ্বিতীয় দিনের জন্য সুন্দর একটা সম্ভাবনাই এঁকেছিলেন সাকিব। আর পেছনে তো মাঠে ফিরে নিজেকে আগের রূপে নিয়ে যাওয়ার অক্লান্ত চেষ্টাটা ছিলই।

স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নারের প্রত্যাবর্তন নিয়ে নির্মিত ‘দ্য টেস্ট’ প্রামাণ্যচিত্রে স্মিথ বলেছেন, মাঠের বাইরে থাকার সময় একটা পর্যায়ে তাঁর এমনও মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো আর খেলায় ফিরবেন না। ফিরলেও আগের সেই খেলাটা আর খেলতে পারবেন না। মাঠে ফেরার ইচ্ছাটাই নাকি তাঁর মরে গিয়েছিল একটা সময়।

টেস্টে আজ দ্বিতীয় দিনে মিরাজের সঙ্গে ভালোই জমেছিল সাকিবের জুটি
ছবি: শামসুল হক

সাকিবের ক্ষেত্রে উল্টোটাই দেখা গেছে। বহিষ্কারের সময়ও মাঠে ফেরার তাড়নার কথা শোনা গেছে তাঁর মুখে। এরপর যখন শাস্তি শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে এল, নিজেকে নতুন করে গড়তে নেমে পড়লেন কঠোর পরিশ্রমে।

বিকেএসপিতে প্রায় এক মাসের অক্লান্ত অনুশীলন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পরিশ্রমের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে আগের সাকিব হয়ে মাঠে ফেরার তাড়না তাঁকে এনে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডের ম্যান অব দ্য সিরিজের স্বীকৃতি।

টেস্টের ফেরাটা হয়তো স্মিথের মতো হয়নি, তবে চট্টগ্রাম টেস্টটাকে রাঙিয়ে তোলার এখনো তো সময় আছে সাকিবের হাতে। বল-ব্যাটের জাদুতে প্রত্যাবর্তনের উপলক্ষটাকে এখনো করে রাখতে পারেন স্মরণীয়। তাতে স্টিভ স্মিথ হয়ে উঠতে না পারলেও অনুচ্চারে একটা ঘোষণা তো দিতেই পারেন সাকিব—সাকিব আছেন সাকিব আল হাসানের মতোই।