'স্বাপ্নো কি রানি'তে মজলেন পাতৌদির নবাব

>ক্রিকেটাররা আগে নায়িকাদের প্রেমে পড়েন, না কি নায়িকারা আগে ক্রিকেটারদের, এটা নিয়ে গবেষনা হতে পারে। গবেষনার ফল যা-ই হোক, এই দুইয়ের মধ্যে যে একটা অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে, তাতে সন্দেহ নেই। যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটার আর নায়িকাদের সফল-ব্যর্থ অজস্র প্রেম এর সাক্ষী। ২২ গজের সঙ্গে রুপালি পর্দার এই প্রেমের গল্প নিয়ে আজ পড়ুন ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব-
শর্মিলা ঠাকুর-মনসুর আলী খান পাতৌদি। ফাইল ছবি
শর্মিলা ঠাকুর-মনসুর আলী খান পাতৌদি। ফাইল ছবি

অক্সফোর্ড ফেরত মনসুর আলী খান পাতৌদির প্রেমে না পড়ার কোনো কারণ ছিল না নারীদের কাছে। সুপুরুষ, ভোপালের নবাব পরিবারের ছেলে, হিন্দী-ইংরেজি-আরবি-ফ্রেঞ্চ ভাষায় পারদর্শী এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক!

কিন্তু সেই পাতৌদি কিনা নিজেই প্রেমে পড়ে গেলেন বলিউড অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের!
শুরুটা সম্ভবত ১৯৬৫ সালের দিকে। দিল্লিতে সিনেমার শুটিংয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা। এক বন্ধুর সুত্রে সেখানেই পরিচয়পাতৌদির সঙ্গে। বিকিনি পরা প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে দর্শক তাঁকে 'অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস' ছবিতে দেখেছে আরও দু বছর পরে। ততদিনে সত্যজিতের 'অপুর সংসার' আর শক্তি সামন্তের 'কাশ্মির কি কলি' করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন শর্মিলা।
তবে ভারতের অধিনায়ক হয়েও শর্মিলার মন পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে পাতৌদির। চার বছর অপেক্ষার পর বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারেন শর্মিলাকে। ১৯৬৯ সালের নভেম্বরে রাজেশ খান্নার সঙ্গে 'আরাধনা' ছবিতে অভিনয় করে 'রূপ তেরামাস্তানা' দিয়ে ভারত কাঁপিয়ে দিলেন শর্মিলা, পরের মাসেই 'স্বাপ্নো কি রানি'কে ঘরে তুললেন পাতৌদি।

সহজ ছিল না সেই বিয়েটাও। পিতা ও মাতা দুই সুত্রেই শর্মিলা জোড়াসাকোর ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। শর্মিলার দাদি ললিতা ছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। আবার বিশ্ব কবির দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথের ছেলে ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ। তাঁর ছেলে গগনেন্দ্রনাথের পুত্র কণকেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী হলেন শর্মিলা ঠাকুর।

শর্মিলার সনাতন বাঙালি হিন্দু পরিবার প্রথমে রাজি হয়নি অবাঙালি মুসলমান ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে। ওদিকে নবাবপরিবার আবার রাজি ছিল না বলিউডের অভিনেত্রীকে নিজেদের পুত্রবধু করতে। কিন্তু পাতৌদি আর শর্মিলা এসব পাত্তা দেননি একেবারেই। আয়েশা সুলতানা নাম নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন শর্মিলা, বিয়ে করেন পাতৌদিকে।

ক্রিকেট আর বলিউডের প্রথম প্রেম ছিল সেটা, সম্ভবত সবচেয়ে সফলও। ২০১১ সালে নবাবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় চারদশকের সুখের সংসার দুজনের। কীভাবে এত গভীর প্রেম ছিল দুজনের সেটাও এক রহস্য।

শর্মিলা ক্রিকেটপাগল মেয়ে ছিলেন, সব ম্যাচের খোঁজ খবর রাখতেন, স্বামীর ম্যাচ তো অবশ্যই। কিন্তু মনসুর আলী খান পাতৌদি সিনেমা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না, এমনকি শর্মিলার কোনো ছবিই তাঁর দেখা হয়নি। অদ্ভুত প্রেম বটে!

রিনা-মহসিন খান। ফাইল ছবি
রিনা-মহসিন খান। ফাইল ছবি

রিনার প্রেমে মহসিন

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রথম যখন খবরটা এলো, রিনা রায়ের কী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া! মহসিন খানের সঙ্গে তাঁর প্রেমের খবরটা নাকি একেবারে ছাইপাশ। অথচ কিছুদিন পরে রিনা-মহসিন দুজনেই সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেন, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা!

রিনা তখন বলিউড ক্যারিয়ারের প্রায় মধ্যে গগনে। 'নাগিন', 'নসিব', 'জানি দুশমন'- এর মতো হিট ছবি দিয়েছেন। রাজেশ খান্নার সঙ্গে দারুন এক জুটি গড়ে উঠেছে। পরিচালকদের লাইন বাড়ছে তাঁর বাড়িতে।
সেই সময় ক্যারিয়ারের সর্বনাশ করে রিনা সিদ্ধান্ত নিলেন মহসিনকে বিয়ে করার। ১৯৮৩ সালে দুজনের বিয়ে সাড়া ফেলেছিল ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই।

এমনিতে মহসিন খুব মহাতারকা জাতীয় ক্রিকেটার ছিলেন না। ওপেনিংয়ে ব্যাট করতেন। ইংলিশ ও অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে ভালো খেলেন বলে একটা সুনাম ছিল। লর্ডসে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে। তবে দেখতে ভালোছিলেন, রিনাও সম্ভবত সেটা দেখেই প্রেমে পড়েছিলেন।

বিয়ের পর রিনা অভিনয় ছেড়ে দেন। কিন্তু দুই দেশে দুজন থেকে ঠিক সংসার জমছিল না। মহসিন নিজেও চেষ্টা করেছেন বলিউডে এসে ক্যারিয়ার গড়তে। জেপি দত্তের 'বাটওয়ারা' ও মহেশ ভাটের 'সাথী' ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু দর্শক তাঁকে নেয়নি। ওদিকে পাকিস্তান গিয়ে মানিয়ে নিতে পারলেন না রিনাও।

ফলাফল, সংসারটা ভেঙ্গে গেল। ততদিনে দুজনের সংসারে চলে এসেছে একমাত্র কন্য সন্তান। ডিভোর্সের পর কন্যা কার কাছে থাকবে এ নিয়ে মামলা গড়ায় আদালতে। শুরুতে মহসিন খানই পেয়েছিলেন কন্যা জান্নাতের দায়িত্বভার। কিন্তু মহসিন পরে দ্বিতীয় বিয়ে করায় মেয়েকে দেওয়া হয় মা রিনার জিম্মায়। এখন কন্যাকে নিয়েই থাকেন রিনা। তবে বাবা মহসিনের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে জান্নাতের।

আজহার-বিজলানি। ফাইল ছবি
আজহার-বিজলানি। ফাইল ছবি

বিজলানি চমকে আজহার

১০ বছরের প্রেম পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল। এমনকি বিয়ের কার্ডও ছাপা হয়ে গিয়েছিল তাদের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভেঙ্গে যায় বলিউড অভিনেতা সালমান খান ও ১৯৮০ সালের মিস ইন্ডিয়া সঙ্গীতা বিজলানির সেই বিয়ে। ঠিক সেই সময়ে বিজলানির জীবনে আসেন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। ভারত অধিনায়ক তখন বিবাহিত, দুই সন্তানের জনক। কিন্তু এসব কবে আর পাত্তা দিয়েছেন বলিউডের নায়িকারা!

খুব সম্ভবত একটা বিজ্ঞাপণের শুটিংয়ে পরিচয়। ২২ গজে কবজি মোচড়ানো শটের জন্য বিখ্যাত আজহার বিজলানির গুগলিতে ঘায়েল হলেন প্রথমবারেই। বছরখানেক প্রেমের পরই দুজন দুজনকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। ১৯৯৬ সালে স্ত্রী নওরীনকে ডিভোর্স দিয়ে সাবেক মিস ইন্ডিয়া সঙ্গীতার পাণি গ্রহন করলেন আজহার।

কিন্তু এমন যে প্রেম, সেটাও টিকল মাত্র ১৪ বছর। বিজলানি থাকতেও আজহার নতুন করে প্রেমে মজলেন ভারতীয় নারী ব্যাডমিন্টন তারকা জোয়ালা গুত্তার। ওদিকে গুজন উঠল গুত্তা একই সঙ্গে প্রেম করছেন আজহারের ছোট ছেলে আয়াজউদ্দিনের সঙ্গেও। এই নিয়ে রেষারেষির জের ধরে ২০১০ সালে আজহারকে ডিভোর্স দেন সঙ্গীতা।

ততদিনে ক্রিকেট ক্যারিয়ার একেবারে শেষ হয়ে গেছে আজহারের। ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়িয়ে ক্রিকেট থেকে আজীবন নিষিদ্ধ হন ২০০০সালেই। পরে রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন ছেলে আয়াজকে, টেকেনি গুত্তার সঙ্গে সম্পর্কও। ভারতীয়ক্রিকেটের 'মোস্ট অ্যাডোরেবল ম্যান' থেকে এক সময় 'মোস্ট হেটেড ম্যান' হয়েই বিদায় আজহারের।

বিতর্কিত এই ক্রিকেটারের জীবনী নিয়ে ২০১৬ সালে পরিচালক টনি ডি সুজা বানিয়েছেন 'আজহার' নামে একটি সিনেমা।যেখানে আজহারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমরান হাশমি, সঙ্গীতার চরিত্রে নার্গিস ফখরি আর আজহারের প্রথম স্ত্রী নওরীনহয়েছেন প্রাচী দেশাই। অবশ্য সমালোচকেরা বলেছেন, সিনেমার আজহারের চরিত্রের প্রতি যথেষ্ট সমব্যথী ছিলেন পরিচালক, যে কারণে চেপে যাওয়া হয়েছে তাঁর নেতিবাচক দিকগুলো।