স্মৃতিটুকুই রইল মুরালিধরন-সাকলায়েনের

সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে আয়োজিত ম্যাচে মুরালিধরন, শেন ওয়ার্ন ও শ্চীন টেন্ডুলকারছবি: এএফপি

আলোচনাটা এখন শুধু দুজনের মধ্যে। শেন ওয়ার্ন না মুত্তিয়া মুরালিধরন, সর্বকালের সেরা স্পিনার কে?

রিচি বেনোর মুখ থেকে শুনলে একটা উত্তর, ‘ওয়ার্ন।’ সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার বা স্পিনারের আটকে ছিলেন না বেনো। অস্ট্রেলিয়ান উত্তরসূরিকে সর্বকালের সেরা বোলার বলেই মানতেন বেনো। কিন্তু বাদবাকি যাঁরা এভাবে ওয়ার্নে মজে ছিলেন না, তাঁদের জন্য সর্বকালের সেরা স্পিনারের বিতর্কটা ওয়ার্ন আর মুরালিধরনে ভাগ করা।

তাঁদের পরে ক্যারিয়ার শুরু করে সবার আগে শেষ করেছিলেন, পাকিস্তান দল থেকে তাঁর ছিটকে পড়াটাও প্রশ্নবিদ্ধ। আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিতে ওজন সবচেয়ে বেশি যে সংস্করণের ক্রিকেটের, সেখানে তুলনামূলক ম্লান বলে সাকলায়েন মুশতাক এখন আর ওয়ার্ন-মুরালিধরনের আলোচনায় জায়গা পান না। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ দিকে এই আলোচনায় খুব ভালোভাবেই ছিলেন পাকিস্তানি অফ স্পিনার। একসময় এই তিনজনের মধ্যে অদৃশ্য এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছিল সংবাদমাধ্যম। ওয়ার্নের চিরবিদায়ে ত্রয়ীর বাকি দুজন শোক জানিয়েছেন কালই।

২০১৫ সালে ক্রিকেট অল স্টারস সিরিজের ম্যাচে তাঁরা তিনজন
ছবি: টুইটার

থাইল্যান্ডে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। ছুটির শুরুতেই ক্রিকেট দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দেওয়া সে খবর এসেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু কিংবদন্তির। এই খবরে ক্রিকেট দুনিয়ার কেউই প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। প্রাণবন্ত এক মানুষ, যাঁর এ ধরনের সমস্যার কথা কেউ কখনো শোনেনি, তাঁর এভাবে আচমকা চলে যাওয়ার খবর যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না।

সবার শোকবার্তাতেই সে অবিশ্বাসের ছাপ। মাঠে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও প্রাণবন্ত শেন ওয়ার্নের সঙ্গে সব ক্রিকেটারের দারুণ সম্পর্ক। শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান লারার সঙ্গে ব্যাট–বলের লড়াই উপভোগ করেছেন। উইকেট নেওয়ার ‘ইঁদুর দৌড়ে’ অফ স্পিনার মুরালিধরনের সমানে পাল্লাকেও নিয়েছেন ইতিবাচকভাবে। অ্যাশেজের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেটারদের সবার কথাতেই স্পষ্ট মানুষ ওয়ার্নের অভাব তাঁরা খুব ভালোভাবেই টের পাবেন।

ওয়ার্ন ও সাকলায়েন
ছবি: টুইটার

কাউন্টিতে খেলার সুবাদে মাঠে ও মাঠের বাইরে সাকলায়েনের সঙ্গে চমৎকার এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ২৪ বছর পর পাকিস্তান সফর করছে অস্ট্রেলিয়া। দুই যুগ আগের সফরে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টেই শুধু খেলেছিলেন সাকলায়েন। এবারও রাওয়ালপিন্ডি দিয়ে শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-পাকিস্তান টেস্ট সিরিজ। গতকাল প্রথম দিনে দাপট দেখিয়েছে পাকিস্তান।

দিনের খেলা শেষ হওয়ার একটু পরই এসেছে স্তব্ধ করে দেওয়া সে খবর। বর্তমানে পাকিস্তান দলের কোচের ভূমিকায় থাকা সাকলায়েনের টুইটে কাল অবিশ্বাসের ছাপই দেখা গেছে, ‘শেনের চলে যাওয়ার খবরে স্তব্ধ হয়ে গেছি। খুবই মন খারাপ হয়েছে। এ খবর মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এ খেলার কিংবদন্তিদের একজন। আমাদের কত স্মৃতি। বিশ্বাসই হচ্ছে না, শেন আর নেই। জীবন আসলেই কতটা অনিশ্চিত আর ঠুনকো। পরিবারের জন্য প্রার্থনা।’

শেন ওয়ার্ন ও মুরালিধরন - একসঙ্গে দুই কিংবদন্তি
ফাইল ছবি

কিন্তু সবাই অপেক্ষা করছিলেন মুরালিধরনের জন্য। ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দুজন বোলার এক হাজারের বেশি উইকেট পেয়েছেন। টেস্ট ও ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি মুরালির সঙ্গে ওয়ার্নের লড়াইটা ছিল দেখার মতো। ওয়ানডেতে একটু আগেভাগেই ক্যারিয়ারের যতি টেনেছিলেন, কিন্তু টেস্টে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়েই ছিলেন ওয়ার্ন। সবার আগে ছয় শ ও সাত শ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন অস্ট্রেলিয়া লেগ স্পিনার। ওদিকে ম্যাচ ও ইনিংসপ্রতি উইকেটে এগিয়ে ছিলেন মুরালিধরন। ওয়ার্ন অবসর নেওয়ার পর তরতর করে এগিয়ে গেছেন। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৮০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়ে তবে থেমেছেন।

ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। মুরালিধরন ‘সস্তা উইকেট’ পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে আছেন, এমন ইঙ্গিত ওয়ার্ন দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা শুধু লড়াকু চেতনার ওয়ার্ন। মানুষ ওয়ার্নের ঠিকই মুরালিধরনের সঙ্গে বন্ধুত্ব। দুজনের বন্ধুত্বের রেশ টের পাওয়া গেল মুরালিধরনের বিদায়ী বার্তায়, ‘কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন যাঁর সঙ্গে আমার বহু বছরের সম্পর্ক, তিনি এত কম বয়সে মারা গেছেন শুনে আমি গভীরভাবে মর্মাহত এবং দুঃখিত। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের আধিপত্যের চূড়ায় ছিলেন। লেগ স্পিন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সত্যিই এক প্রতিভা ছিলেন। যেভাবে বোলিং ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ।’

দুজনের সম্পর্কটা আরও গভীর করেছিল এক মানবিক বিপর্যয়। ২০০৪ সালের সুনামি শ্রীলঙ্কাকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে দিয়েছিল। প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বাস্তুহারা হয়েছিলেন পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এই মহাবিপদে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মুরালিধরন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শেন ওয়ার্নও। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া হয়েছিল বিশ্ব একাদশ। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারতকে নিয়ে গড়া হয়েছিল এশিয়া একাদশ। বাংলাদেশের অলক কাপালি ছিলেন এশিয়া একাদশের দ্বাদশ খেলোয়াড়।

এ ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে ব্যয় করা হয়েছিল। তবে শেন ওয়ার্ন এখানেই নিজেকে আটকে রাখেননি। মুরালিধরনের ডাকে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায়। বিদায়ী বার্তায় সে সময়ের কথাও টেনেছেন মুরালিধরন, ‘একসঙ্গে যে দারুণ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি সেগুলোতে তাঁকে স্মরণ করব। তাঁর পরিবার ও নিকটজনদের প্রতি আমার আন্তরিক ও গভীর সমবেদনা জানাই। তাঁর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব, শেষ দিকে শীর্ষস্থানীয় এক ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তাঁর অভাব টের পাব আমরা। সুনামির পর মানবতাকে সমৃদ্ধ করতে আমরা যখন এক হয়েছিলাম, তখন সিক্সটি মিনিটস অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সিনিগামায় এসেছিলেন। পুনর্নির্মাণ, পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনের জন্য সচেতনতা তৈরিতে ফাউন্ডেশন অব গুডনেস সংস্থাকে যেভাবে সমর্থন দিয়েছেন, আমি কখনো ভুলব না।’