১৪ বছর পরও মন কাঁদছে আফ্রিদির

আফ্রিদি।
ফাইল ছবি : এএফপি

মার্চ ১৭, ২০০৭। আয়ারল্যান্ডের অধিনায়ক ট্রেন্ট জনস্টন লং অনে বিশাল ছক্কা হাঁকালেন। পাকিস্তানকে হারিয়ে অবিশ্বাস্য গল্প লিখল আয়ারল্যান্ড। পাকিস্তান দলের প্রতিভার ভারের সঙ্গে আইরিশদের তুলনা করে ম্যাচটা পেয়ে যায় ২০০৭ বিশ্বকাপের বড় অঘটনের স্বীকৃতি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে পাকিস্তানের সেই বিশ্বকাপ অভিযান গ্রুপ পর্বে থামিয়ে দিয়ে শেষ আটে উঠে যায় আয়ারল্যান্ড।

কিন্তু সেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় কি সেটি ছিল? হয়তো না! জীবনই যেখানে চলে যায়, একটা ম্যাচে হার-জিতের প্রশ্ন তো সেখানে মূল্যহীন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের ভিত গড়ে দেওয়া অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১৪৯ কিংবা বাংলাদেশের কাছে হারের পর টেন্ডুলকার-সৌরভ-দ্রাবিড়দের ভারতেরও গ্রুপ পর্বে বিদায়...ক্যারিবিয়ান সাগরপাড়ের সেই বিশ্বকাপে এসবের পাশাপাশি ঢেউ তুলেছিল ঠিক ১৪ বছর আগে আজকের দিনের এক মৃত্যুর ঘটনা।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে হারের পরদিন, ১৮ মার্চ, এল পাকিস্তান ক্রিকেটে অন্ধকার নামিয়ে আনা খবরটা। হোটেলে নিজের কক্ষে পাওয়া যায় পাকিস্তানের সে সময়ের কোচ বব উলমারের মৃতদেহ। কেন, কীভাবে হলো সে মৃত্যু, তা এখনো রহস্যে ঘেরা। রহস্যের সমাধান কখনো হবে কি না, কে জানে। হয়তো শান্তি মিলবে না তাঁকে হারিয়ে কাঁদতে থাকা মনগুলোরও। পাকিস্তানের সাবেক অলরাউন্ডার শহীদ আফ্রিদির যেমন মিলছে না। ‘ল্যাপটপ কোচ’খ্যাত এই ইংলিশ কোচের মৃত্যুর ১৪ বছরপূর্তিতে উলমারকে স্মরণ করে আফ্রিদির টুইট তা-ই বলে।

এই ছবি পোস্ট করে উলমারকে স্মরণ করেছেন আফ্রিদি।
ছবি: টুইটার

‘বব যখন আমাদের কোচিং করিয়েছিলেন, সে সময়টাতেই একজন কোচের ভূমিকা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। তরুণ খেলোয়াড়দের কাছে একজন বাবার মতো। ম্যাচে হারি বা জিতি, ভালো খেলি বা খারাপ, প্রতি ম্যাচের পর তাঁর কাছে পারফরম্যান্সের ব্যাপারে জানতে চাইতাম আমরা’—টুইটে লিখেছেন আফ্রিদি। বব উলমারের সঙ্গে নিজের একটা ছবি দিয়ে টুইটের শেষে লিখেছেন, ‘তোমাকে মিস করি, বব।’ পাশে একটা ভালোবাসার ইমোজি।

২০০৪ সালে পাকিস্তানের কোচের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বব উলমার। দায়িত্বে একেবারে সাফল্যের বান নামিয়েছিলেন, তা বলা যাবে না। তবে জয়ের মুহূর্ত এসেছে মাঝেমধ্যে। ভারতে এসে ওয়ানডে সিরিজে ৪-২ ব্যবধানে জেতে পাকিস্তান, এরপর নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কাকে হারায়। কিন্তু ২০০৭ বিশ্বকাপটা আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে। প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে পর্যুদস্ত পাকিস্তান। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে তখনো অবশ্য সমীকরণটা সোজাই, অন্তত কাগজে-কলমে—বাকি দুই ম্যাচে আয়ারল্যান্ড আর জিম্বাবুয়েকে হারাতে হবে। এ আর এমন কী!

কিন্তু আয়ারল্যান্ড ঘাড় বাকিয়ে দাঁড়াল! পাকিস্তানকে ১৩২ রানে অলআউট করে দিয়ে নিয়াল ও’ব্রায়েনের ৭২ রানের সৌজন্যে তা পেরিয়ে গেছে ৩ উইকেট ও ৩২ বল হাতে রেখে। বিশ্বকাপ শেষ পাকিস্তানের!

আয়ারল্যান্ডের সে জয় চমকে দিয়েছিল সবাইকে।
ছবি: সংগৃহীত

এর পরদিনই ক্রিকেট–বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া খবরটা এল। প্রথমে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানায়, উলমার হার্ট অ্যাটাকের কারণে মারা গেছেন। কিন্তু ২১ মার্চ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাকিস্তানের শেষ ম্যাচের পর (সে ম্যাচে অবশ্য জিতেছে পাকিস্তান) খবর এল, জ্যামাইকান পুলিশ উলমারের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত কেন? এক প্রতিবেদন বেরোয়, প্যাথলোজিস্টের প্রতিবেদনে এসেছে, কেউ একজন উলমারের গলা চেপে ধরায় শ্বাস আটকে মারা যান উলমার।

গুজবের তখন কমতি ছিল না! কেউ বলছিলেন, উলমার হয়তো কোনো বেটিং কলঙ্কের কথা জেনে গিয়েছিলেন, সেটি ধামাচাপা দিতে তাঁকে মেরে ফেলা হয়। কেউ তত্ত্ব নিয়ে আসেন, বিশ্বকাপে দলের এরূপ পারফরম্যান্সে ক্ষিপ্ত কোনো পাকিস্তানি সমর্থক ইংলিশ কোচকে মেরে ফেলেছেন। কেউ কেউ তো উলমারের মৃত্যুতে পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের হাতও দেখছিলেন। হ্যান্সি ক্রনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিনায়ক থাকার সময়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কলঙ্ক যখনকার কথা, সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ ছিলেন উলমার, সে কারণে তাঁর মৃত্যুর পেছনে ক্রিকেট–মাফিয়ার হাত দেখছিল।

পাকিস্তানের স্পিনার দানিশ কানেরিয়া ছিলেন উলমারের পাশের কক্ষে। কিন্তু তদন্তে তিনি বলেন, উলমারের কক্ষ থেকে রাতে কোনো আওয়াজ তিনি পাননি। সে কারণে ধারণা জন্মায়, উলমারকে যদি হত্যা করা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে উলমার তাঁর হত্যাকারীদের আগে থেকে চিনতেন।

পাকিস্তান ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাই আজ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন উলমারকে।
ছবি: টুইটার

মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৮, তাঁর উচ্চতা ৬ ফুট, ওজন ছিল ১০০ কেজির বেশি...এসব তথ্য হিসাবে নিলে, অপরিচিত কারও পক্ষে তাঁকে শক্তিতে হারিয়ে মেরে ফেলা সহজ হওয়ার কথা ছিল না। আর তেমন হলেও ধস্তাধস্তিতে আওয়াজ হওয়ার কথা ছিল, যা কানেরিয়ার শুনতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।

বিশ্বকাপ শেষে পাকিস্তান দল যখন লন্ডনের উদ্দেশে উড়োজাহাজে উঠবে, দলের অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক, সহকারী কোচ মুশতাক আহমেদ ও দলের ম্যানেজার তালাত আলীকে থেকে যেতে বলে পুলিশ। তাঁদের আগের দেওয়া বিবৃতি আরও প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ইনজামাম-মুশতাকদের রেখে দেওয়া।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই তদন্তে কোনো সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পায়নি বলে জানায় পুলিশ। বিবৃতি দেয়, উলমারের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো উলমারের মৃত্যু যেন একটা রহস্যে ঘেরা উপন্যাস হয়ে আছে। তবে মৃত্যু যেভাবেই হোক, দিন শেষে তাঁর পরিবার, বন্ধু, কাছের মানুষের কাছে সত্যিটা হচ্ছে, এই দিনে উলমারকে হারিয়েছেন তাঁরা। আফ্রিদির টুইট তা আরেকবার মনে করিয়ে দিল।