১৯৮৮ সালে কাতার এসেছিলেন ক্রিকেট খেলতে, তারপর...

কাতার ক্রিকেট দলের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম (ডানের নীল শার্ট)।সংগৃহীত ছবি

কাতারে সাধারণত বাংলাদেশিরা আসেন বিভিন্ন চাকরির সুবাদে। প্রায় সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন এই দেশে। তবে আমিনুল ইসলামের আসাটা ব্যতিক্রম। তিনি এসেছিলেন কিনা ক্রিকেট খেলতে!

সেটাও সেই ১৯৮৮ সালে। সেই থেকে ৩৩ বছর ধরে এই দেশেই তাঁর বসত। আস্তে আস্তে কাতারের ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন। বর্তমানে কাতার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হেড অব স্কুল ক্রিকেট বয়েজের দায়িত্বে আছেন। দুই বছর ধরে কাতার অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের ম্যানেজারও তিনি।

কাতারে ফুটবলই এক নম্বর খেলা। ২০২২ সালে দেশটি বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করছে। বিশ্বকাপ নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ চলছে এখন। ফুটবলের দেশ কাতারে ক্রিকেট শৌখিন স্তরেই রয়ে গেছে। কাতারিরা ক্রিকেট খেলে না। মূলত ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কান ও বাংলাদেশিরাই এ দেশে ক্রিকেটে ঝান্ডা হাতে নিয়েছেন। সেই সুবাদে বহুজাতিক এক ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আরব দেশটিতে।

সেই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন কুমিল্লা থেকে উঠে আসা আমিনুল ইসলাম। দোহার হোটেলে বসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সালে বিকম পরীক্ষা দিয়ে বসেই ছিলাম দেশের বাড়ি। তখন দোহায় আমার এক মামাতো ভাই থাকতেন। তিনি খবর দিলেন দোহা আসতে (ছয় মাসের অন্য একটি কাজের ভিসায় আসা)। এখানে তখন অবসরে টুকটাক ক্রিকেট খেলা হয়। ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্তরা একটি বাংলাদেশি ছেলে চায়, যে ক্রিকেট খেলতে পারে। এভাবেই আমি এখানে এসে ক্রিকেট খেলা শুরু করি এবং সংশ্লিষ্টদের নজরে পড়ি। পরে ওরা প্রস্তাব করে থেকে যেতে। আমিও রয়ে গেলাম।’

কাতার অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম (মাঝে)।
সংগৃহীত ছবি

কুমিল্লা জেলা দলে খেলার সুবাদে ক্রিকেটটা তাঁর জানাই ছিল। কাতার এসে আট-নয় বছর ক্রিকেট খেলেন। এরপর আস্তে আস্তে কাতারের ক্রিকেট প্রশাসনে ঢুকে পড়া। কাতার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজার হিসেবে দল নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ান বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। মূল জাতীয় দলের সঙ্গেও ভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে সফর করেছেন। তা ছাড়া তিনি কাতারে বাংলাদেশ কমিউনিটির ক্রীড়া সমন্বয়কারী।

আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও অনেক ছোট কাতার। আয়তন মাত্র সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ২৭ লাখের মতো। তাতে কী, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ দুটি বয়সভিত্তিক জাতীয় ক্রিকেট দল আছে কাতারের। মূল জাতীয় দল তো রয়েছেই। তবে এই দলগুলোতে কোনো কাতারি নেই। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কানদের নিয়েই মূলত গড়া হয় কাতারের ক্রিকেট দল। আগে থাকলেও এখন অবশ্য কাতারের ক্রিকেট দলে বাংলাদেশের কেউ নেই।

এ নিয়ে আমিনুল ইসলামের কিছুটা আফসোস রয়েছে, ‘কাতার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে আগে বাংলাদেশের চারটি ছেলেকে খেলিয়েছি আমরা। সাঈদ ওমর, রফিকের কথা বলতে পারি। সবার আগে ইমরান আসে। এখন সে অস্ট্রেলিয়া আছে। বছর চারেক আগে সিনিয়র জাতীয় দলে শিহাব উদ্দিন ছিল। এখন সিনিয়র দলে বাংলাদেশের কেউ নেই। ভাবলে কিছু হলেও খারাপ লাগে।’

কাতার জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলতে কিছু নিয়ম আছে। আগে শর্ত ছিল, সাত বছর কাতারে বসবাস করতে হবে। প্রতিবছর অন্তত ১৮০ দিন কাতারে থাকা আবশ্যক। তবে এখন সময় কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে। অবশ্য এখন বছরে অন্তত ১০ মাস থাকা বাধ্যতামূলক

কাতার প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্রিকেট দল।
সংগৃহীত ছবি

শর্ত পূরণ করে উপমহাদেশের কিছু মানুষ যুক্ত হয়ে পড়ছেন কাতার ক্রিকেটের সঙ্গে। দোহায় টি-টেন লিগ হয়। বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল, আরাফাত সানি, ইলিয়াস সানি, মোহাম্মদ শরিফরা এসেছেন। ১৮ ডিসেম্বর কাতারের জাতীয় দিবস, দিনটি পালন উপলক্ষে প্রতিবছর কাতার জাতীয় দল এবং এশিয়া একাদশের মধ্যে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন হয়ে আসছে (অবশ্য করোনার কারণে এ বছর হবে না)। এশিয়া একাদশে খেলেন মূলত অবসরে যাওয়া তারকারা। সনাৎ জয়াসুরিয়া, ইউনিস খান, মিসবাহ-উল-হক, সাঈদ আজমল, শহীদ আফ্রিদি, হাফিজ, থিসারা পেরেরারা খেলেছেন। আজহারউদ্দিন, ইকবাল সিকান্দার, রবি রত্নায়েক, ভেঙ্কটাপতি রাজু, আরশাদ আইয়ুব, মোহাম্মদ কাইফ, ভেংকটেশ প্রসাদ—কে আসেননি এই উৎসবে!

এখানে ক্রিকেট দল আছে ৮৪টি। প্রিমিয়ারসহ তিনটি স্তরে খেলা হয়। সর্বশেষ টি টোয়েন্টিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিটি। এভাবেই আমরা কাতারের ক্রিকেটে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছি।
আমিনুল ইসলাম

১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে কাতারে ক্রিকেটচর্চা শুরু। ওই সময় উপমহাদেশের কিছু ছেলে এখানে শৌখিন ক্রিকেট খেলতেন। সেটাও ছিল ২০ ওভারের। শুধুই শুক্রবার খেলা। ভারতীয়, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কানরা খেলতেন। তখন বাংলাদেশি কেউ ছিলেন না। ক্রিকেট নিয়ে কাতারের মানুষের আগ্রহ না থাকলেও খেলাটি এগোচ্ছে। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আগে দোহায় ক্রিকেট মাঠ ছিল না। চট দিয়ে শুক্রবার ছুটির দিনে খেলা হতো পার্কে। এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ঘাসের মাঠ আছে। পরিপূর্ণ ক্রিকেট স্টেডিয়াম এশিয়ান টাউন। ক্রিকেট খেলার মাঠ আছে ১২টি।’

স্থানীয়ভাবে ক্রিকেট লিগ হয় নিয়মিত। এ–সংক্রান্ত আমিনুল ইসলামের দেওয়া তথ্যটি বেশ অবাক করা, ‘এখানে ক্রিকেট দল আছে ৮৪টি। প্রিমিয়ারসহ তিনটি স্তরে খেলা হয়। সর্বশেষ টি টোয়েন্টিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিটি। এভাবেই আমরা কাতারের ক্রিকেটে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছি।’

পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, বাংলাদেশিরা তার সৃজনশীলতা দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন। আমিনুল ইসলাম যার বড় উদাহরণ। এখন তিনি এখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে দোহায় বসত গড়েছেন অনেক আগেই। সন্তানেরা এখানে পড়াশোনা করে চাকরিতেও ঢুকেছেন। তবে ১৯৮৮ সালে প্রথমবার এসে ভাবতে পারেননি এত দূর পাড়ি দেবেন। পরিশ্রম আর একাগ্রতা আজ তাঁকে তুলে এনেছে এই অবস্থানে। কাতারের ক্রিকেটে যিনি আজ পরিচিত এক বাংলাদেশি মুখ।