২১ বছরে টেস্ট নিয়ে তাহলে কী করলাম আমরা?

টেস্টে গত ২১ বছরে কিছুই শেখেনি বাংলাদেশ!ছবি: শামসুল হক

‘এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, রঘুরাজ!’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের এ কাব্যচরণ মনে পড়ে যেতেই পারে ক্রিকেটপ্রেমীদের। টেস্ট ক্রিকেটে ২১ বছর পার করে দেওয়ার পর অধিনায়ক মুমিনুল হক সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় সেভাবে কোনো উন্নতিই হয়নি!’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির দলের কাছে টানা দুই টেস্টে হেরে ধবলধোলাই হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়কের মুখে যদি এমন কথা শোনা যায়, তাহলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে—২১ বছর ধরে তাহলে বাংলাদেশের টেস্ট দল কী করল, কী শিখল!

২০০০ সালের নভেম্বরে প্রথম টেস্টটা খেলার পর থেকেই টেস্ট মানেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বিষাদময় অভিজ্ঞতা যেন। যেন টেস্ট মানেই হারের উপলক্ষ। একটা সময় যখন ক্রিকেটপ্রেমীরা হারটার নিয়ে না ভেবে জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে রাখতেন, তখনো টেস্টের বেশ কিছু হার সবাইকে কষ্ট দিত। বিশেষ করে বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না, বাংলাদেশ টেস্ট খেলার যোগ্য কি না, ক্রিকেট দুনিয়ায় এসব কথাবার্তা যখন উঠত, তখনো ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে করতেন, তাঁদের কষ্টের সময়টা সাময়িক। একদিন না একদিন ঠিকই আঁধার কেটে যাবে। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে টেস্ট ক্রিকেটের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ শক্তি। কিন্তু সময় তো আর বসে থাকে না, এমন করতে করতে তো ২১টা বছরও কেটে গেছে। সময়টা তো নেহাত কম নয়। এতগুলো বছর পর দেশের শীর্ষ কোনো ক্রিকেটার ও টেস্ট দলের অধিনায়কই যদি বলে বসেন, ‘আমরা তেমন কিছু শিখিনি’, তাহলে তো চিন্তিত হতেই হয়!

টেস্টে ভালো দল হয়ে ওঠার মৌলিক বিষয়গুলোতে ঘাটতি রয়ে গেছে।
ছবি: প্রথম আলো

টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে ২১ বছর আমরা কী করলাম, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই চলে আসে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এই দুই দশকে আমরা টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতি কতটা গড়ে তুলতে পেরেছি? ক্রিকেটের ধ্রুপদি সংস্করণে ভালো করতে হলে ক্রিকেটারদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একটা অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। তাঁদের চিন্তাভাবনাকে টেস্ট ক্রিকেটকেন্দ্রিক হিসেবে তৈরি করতে হয়। আমরা কি সেটা করেছি? ১৯৯৯ সালে জাতীয় ক্রিকেট লিগ দিয়ে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয় দেশে। কিন্তু এই জাতীয় লিগের গুরুত্ব ক্রিকেটারদের মধ্যে কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি আমরা। ভারতে রঞ্জি ট্রফি নিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের যেমন আগ্রহ, আমাদের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে কি সেই আগ্রহ গড়ে তুলতে পেরেছি?

টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? অবশ্যই একটা ভালো দল হয়ে ওঠা। সেটি করতে গেলে পদ্ধতিগতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পরিকল্পনা কি কখনো পদ্ধতিগতভাবে এগিয়েছে? টেস্ট ক্রিকেটে ভালো দল হয়ে উঠতে যে মৌলিক বিষয়গুলোয় মনোযোগী হতে হয়, সেগুলোয় যে আমরা মন দিয়েছি, তার কোনো দৃশ্যমান প্রমাণ নেই। স্কুল ক্রিকেটে দীর্ঘ সংস্করণ চালু করা, বয়সভিত্তিক দলগুলোকে দিয়ে বেশি বেশি বড় সংস্করণের ক্রিকেট খেলানো, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলোয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানো। এসব টুর্নামেন্টকে আকর্ষণীয় করা, আরও বেশি করে প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট আয়োজন—পাঁড় ক্রিকেটপ্রেমীরাও বলতে পারবেন না গত ২১ বছরে এসব ঠিকঠাক হয়েছে। টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আমাদের সব পরিকল্পনাই ‘করতে হবে বলে করা’। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে কোনো কিছু করার উদ্যোগের যে অভাব, সে কারণেই টেস্টে আমরা কখনোই মোটামুটি মানের একটা দলও হয়ে উঠতে পারিনি।

দীর্ঘ সংস্করণের অভ্যেসটাই গড়ে ওঠছে না এ দেশের ক্রিকেট–সংস্কৃতিতে।
ছবি: প্রথম আলো

ভারতীয় ক্রিকেটের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে চলে আসবেই। কেবল সুষ্ঠু পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নতি আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলার ফলই আজ তারা পাচ্ছে। গোটা ভারতে ক্রিকেটের একটা দারুণ সংস্কৃতি বিদ্যমান। রাজ্য ক্রিকেট সংস্থাগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলোয়াড় তৈরির খনি। সবাই আইপিএলের কথা বলবেন। কিন্তু তাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের কাঠামো নীরবে-নিভৃতে যে কত দুর্দান্ত সব ক্রিকেটার তৈরি করছে, সে প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতীয় ক্রিকেট দলের দিকে তাকালেই। এই যে অস্ট্রেলিয়াতে দারুণ খেলে ভারত জিতল, নতুন নতুন ক্রিকেটার একেকজন ‘ম্যাচ উইনার’ হয়ে উঠলেন, সেটি তো ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ঘরোয়া ক্রিকেট অবকাঠামোর জন্যই। ব্রিসবেন টেস্টে চোট সমস্যার কারণে একটা একাদশ নামানোই যেখানে কঠিন হয়ে পড়েছিল ভারতীয় দলের জন্য, সেখানে আনকোরা খেলোয়াড়েরাই দেশকে জিতিয়েছেন দারুণ পারফরম করে। শুভমান গিল, হনুমা বিহারি, মায়াঙ্ক আগারওয়াল, ঋষভ পন্ত, ওয়াশিংটন সুন্দর, শার্দুল ঠাকুর, মোহাম্মদ সিরাজদের দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা সবাই যেন তৈরি হয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে এসেছেন। এই ‘তৈরি’টা তাঁরা হয়েছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে। ভালো উইকেটে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে—গত ২১ বছরে আমরা এই বিষয়গুলোতেই মনোযোগী হইনি। সে কারণেই ভুগে চলেছে আমাদের ক্রিকেট।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই টেস্টেই জিততে পারত বাংলাদেশ দল। কিন্তু জিততে পারেনি। ক্যারিবীয় দলে তাদের সিনিয়র ক্রিকেটাররা অনেকেই ছিলেন না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার নিয়ে গড়া এই দলটার সঙ্গে খেলতে গিয়েই টেস্ট দলের কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে এসেছে। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে আমাদের শীর্ষ ক্রিকেটারদের অনভ্যস্ততা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। এর জন্য দায়ী ওই টেস্টের সংস্কৃতিহীনতাই।

২১ বছরে টেস্ট খেলার মৌলিক বিষয়গুলোই ঠিকঠাক প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তাহলে কীভাবে টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করবে বাংলাদেশ? আর এসব দেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক ভালো জানেন বলেই নির্বিকারভাবে সংবাদ সম্মেলনে বলতে পারেন, ‘আমরা তেমন উন্নতি করতে পারিনি।’ ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য কথাগুলো কষ্টের হলেও এটাই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।