'এ কারণেই তারা খেলছে, আমরা বসে দেখছি'

ট্রেন্টব্রিজের গ্যালারিতে মেলা বসেছিল বাংলাদেশের পতাকার। লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়েছিল ইংরেজ শিশুরাও। ছবি: রানা আব্বাস
ট্রেন্টব্রিজের গ্যালারিতে মেলা বসেছিল বাংলাদেশের পতাকার। লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়েছিল ইংরেজ শিশুরাও। ছবি: রানা আব্বাস

বিশ্বকাপ কাভার করতে এলেই যে প্রতিটি ম্যাচ প্রেসবক্সে বসে দেখা যাবে, এটির নিশ্চয়তা আইসিসি দেয় না। প্রেসবক্সে বসতে অনেক আগেই আবেদন করতে হয়। আবেদন সফল হলে তবেই প্রেসবক্সে বসার জায়গা মেলে। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা ঝুলে (পেন্ডিং) ছিল অনেক দিন। ম্যাচের আগের দিন জানা গেল, আবেদন ‘নিষ্ফল’।

তাহলে উপায়? এত দূর এসে ম্যাচটা কি দেখতে হবে টিভিতে? সমাধান পাওয়া গেল। ম্যাচের ঘণ্টা দু-এক আগে কষ্টেসৃষ্টে একটা টিকিট জোগাড় হলো। ট্রেন্ট ব্রিজে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা দেখতে হবে গ্যালারিতে, ‘দর্শক’ হয়ে। কত দিন পর এমন নিখাদ দর্শক হয়ে একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখা! সেটিও আবার বিশ্বকাপের ম্যাচ। নিশ্চিত এ পরিস্থিতিতে না পড়লে দর্শক হয়ে ইংল্যান্ডে হওয়া ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচ কখনো দেখাই হতো না।

যতই দর্শকসারিতে বসা হোক, সাংবাদিক-সত্তা তো তাতে উবে যায় না! খেলাটা তাই দেখতে হয় পেশাদার সাংবাদিকের চোখে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যান-বোলারদের সাফল্যে তাই অন্য দর্শকদের সঙ্গে হুল্লোড় করা হয় না, উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া যায় না। আবার হতাশায় ক্রিকেটারদের ইচ্ছেমতো গালিবর্ষণও করা যায় না। খেলাটা দেখতে হয় তৃতীয় নয়ন দিয়ে। একজন ম্যাচ দেখছেন আবার নোট নিচ্ছেন—সেটি দেখা পাশে বসা অন্য দর্শকেরা একটু অবাক চোখে তাকান। একবার তো এক নিরাপত্তাকর্মী এসে জানতেই চাইলেন, ‘আপনি কী লিখছেন?’

দর্শকেরা কত দৃষ্টিকোণ থেকে যে ম্যাচ দেখেন, কতভাবে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করেন, কত বিচিত্র ধারণা পোষণ করেন—দর্শকসারিতে বসে সেটা আরেকবার উপলব্ধি করার সুযোগ হলো। সিটটা ছিল লং অফ কিংবা ফাইন লেগের পেছনেই। এই পজিশনে ফিল্ডিং করতে আসা বাংলাদেশের ফিল্ডার রুবেল হোসেনকে নিয়ে অবিরত মজা করতে থাকলেন দর্শকেরা। বিশেষ করে তিনি ‘হ্যাপি’ কি না, প্রশ্নটাই বেশি করা হলো। দর্শকদের এসব ঠাট্টা-রসিকতায় অভ্যস্ত রুবেল অবশ্য এসবে পাত্তাই দিলেন না। বার কয়েক ‘সৌজন্যে’র খাতিরে ‘থাম্বস আপ’ দিলেন।

তবে সবচেয়ে বেশি ‘স্লেজিং’ করা হলো অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম জাম্পাকে। জাম্পা যতবারই সীমানার কাছে ফিল্ডিং করতে এলেন, ততবারই কত কিছু বলে যে খোঁচানো হলো তাঁকে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকেরাই বেশি ‘মজা’ নিলেন তাঁর সঙ্গে। ‘জাম্পা লাভিউ ম্যান’! ‘জাম্পা প্লিজ ডু সামথিং উইথ বল’। হঠাৎ কেউ একজন রাবারের একটা বল ছুড়ে দিলেন জাম্পার দিকে। ‘সরি বলটা হাত থেকে ফসকে গেছে, একটু কুড়িয়ে দেবে?’—এ অনুরোধে অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার বলটা যেই হাতে তুলেছেন, অন্তত ১০ জন বলে উঠলেন, ‘জাম্পা এখানে ছুড়ে দাও’। বলটা তিনি কোনো দর্শককে নয়, ছুড়ে দিলেন নিরাপত্তাকর্মীদের দিকে। একই পজিশনে ফিল্ডিং করতে আসা ম্যাক্সওয়েলকে দর্শকেরা বারবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ম্যাক্স আর ইউ ওয়েল?’

দর্শকদের এই ভালোবাসা, এই অত্যাচারের সঙ্গে ক্রিকেটাররা ভীষণ পরিচিত বলে তাঁরা বিরক্ত হন না। বরং হাসিমুখে মেন নেন। হঠাৎ সীমানায় ফিল্ডিং করতে আসা সৌম্য সরকার কিংবা প্যাট কামিন্স তাই খুশিমনেই ব্যাটে কিংবা ক্যাপে সই দিলেন, সেলফি-ছবি তুললেন। এখানে আবার ঘটল আরেক ঘটনা। এক খুদে দর্শক যখন কামিন্সের সই নিচ্ছে, সম্প্রচার চ্যানেলের ক্যামেরা সে চিত্র আবার ধারণ করছিল। কোত্থেকে একজন দৌড়ে এসে খুদে দর্শককে জড়িয়ে ধরল, যেন তাঁকেও ক্যামেরায় দেখায়! এ দৃশ্য দেখে হাসির রোল উঠল রেডক্লিফ গ্যালারিতে। একজন আবার এটি দেখে বললেন, ‘কিছু মানুষ আছে, ক্যামেরায় মুখ দেখাতে এত নির্লজ্জ হতে পারে!’

এত সব ঘটনার ফাঁকে অবশ্য সবার মনোযোগ ম্যাচেই থেকেছে। কেউ একজন ভালো খেললেই যেমন হর্ষধ্বনি, খারাপ খেললেই তাঁকে তুমুল গালাগাল। এক অস্ট্রেলিয়ান দর্শক যখন সমালোচনার চাবুক ছোটাচ্ছেন ক্রিকেটারদের ওপর, পাশ থেকে একজন থামিয়ে দিলেন তাঁকে, ‘এ কারণেই তো ভাই তারা খেলছে, আর আমরা এখানে বসে দেখছি।’