অনুপ্রেরণা ৩২ বছর আগের স্মৃতি

বাদল রায়ের গোলে এলো এশিয়াড ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম জয়।  ছবি: সংগৃহীত
বাদল রায়ের গোলে এলো এশিয়াড ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম জয়। ছবি: সংগৃহীত

বাদল রায়কে আজও উদ্বেলিত করে সেই স্মৃতি। এশিয়ান গেমসের ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম জয় পাওয়ার সেই ঘটনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যে তিনিই। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়ের সেই জয়সূচক গোলটি এসেছিল তাঁর পা থেকেই। ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়ান গেমসের সেই জয় আজ এত বছর পর আবারও এশিয়াড খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে কি না, সেটা অবশ্য নিশ্চিত নন এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই তারকা। আজ থেকে ৩২ বছর আগে পাওয়া ওই জয়টি নিয়ে যে এত বছর পর স্মৃতিচারণা করতে হচ্ছে, সেটাই নাকি তাঁকে সবচেয়ে বেশি অবাক করছে।

প্রথম আলোর সঙ্গে এশিয়াড ফুটবলে প্রথম জয়ের স্মৃতি নিয়ে আলাপকালে বাদল রায় যেন কিছুটা বিব্রত, ‘কী হবে ওই স্মৃতি নিয়ে আলাপ করে। এখন তো আমরা নেপাল-মালদ্বীপের কাছেও হেরে যাই।’ এই মন্তব্য শুনে তাঁকে বলতেই হলো এশিয়ান গেমসে খেলতে নামার আগে ওই জয়টা যদি মামুনুল বাহিনীর অনুপ্রেরণার উৎস হয়! স্মিতহাস্যে জাতীয় দলের সাবেক এই স্ট্রাইকারের মন্তব্য, ‘অনুপ্রেরণার উৎস হবে কি না, সেটা আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার খেলোয়া​ড়ি জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতি হয়ে আছে ওই জয়টা।’

তা-ই সই! নিজের খেলোয়া​ড়ি জীবনের সেরা স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবারই তাঁর কণ্ঠে ঝরল হতাশা আর আক্ষেপ, ‘৩২ বছর আগে আমরা মালয়েশিয়াকে হারিয়েছি। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দলগুলো আমাদের কাছে ওই সময় হেরেছে। এত বছর পর ফুটবলের তো অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা সেটা পারিনি। কেবলমাত্র সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই ফুটবলের আজ এই অবস্থা। সংগঠক হিসেবে এর দায়ভার আমার কাঁধেও বর্তায়।’

আক্ষেপে কণ্ঠ ডুবিয়ে বাদল রায় অবশেষে ফিরে গেলেন ৩২ বছর আগে, ‘বিরাশির এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ফুটবল দল ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। চীনের বিপক্ষে সমানতালে লড়াই আজ কল্পনাও করা যায় না। ম্যাচটি আমরা হেরেছিলাম ১-০ গোলে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটাও ছিল ফিফটি-ফিফটি। গোলরক্ষক মোতালেবের দুটি মারাত্মক ভুলে আমরা গোল খেয়েছিলাম। আরেকটু চেষ্টা করলে আমরা সেবার হয়তো পরের রাউন্ডেই খেলতাম। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি তো আমরা জিতেই গেলাম। আমি জয়সূচক গোলটা করেছিলাম। অপর গোলটি করেছিল আশীষ ভদ্র।’

বাদল বলে যান, ‘তখন জাতীয় দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে ছিল মারাত্মক প্রতিযোগিতা। দুঃখজনক একটি ঘটনায় দিল্লি এশিয়াডের দলে ছিলেন না সালাউদ্দিন ভাই, আশরাফউদ্দিন চুন্নুর মতো খেলোয়াড়। একই ঘটনায় ছিলেন না কাজী আনোয়ার কিংবা গোলাম রব্বানি হেলাল। তার পরও দিল্লি এশিয়ান গেমসে যে দলটা নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম, সেটা ছিল দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ।’

দলে প্রতিযোগিতা নিয়ে বাদল রায় জানিয়েছেন দারুণ একটি তথ্যও, ‘সেবার আমাদের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন মোতালেব। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে দুটি বাজে গোল খেয়ে তিনি একাদশ থেকে বাদ পড়েন। চীন ও মালয়েশিয়ার বিপক্ষে পরের দুটো ম্যাচে খেলে তরুণ গোলরক্ষক মহসিন। ভাবতে পারেন, মোতালেব আর কোনো দিন দলে জায়গা পাননি। এর পরের ১২-১৩ বছর পুরোটাই ছিল জাতীয় দলে মহসিনের দাপট। সে তো এ দেশের ফুটবল ইতিহাসেরই একজন সেরা। দিল্লি এশিয়ান গেমস মহসিনের আবির্ভাবের জন্যও স্মরণীয় হয়ে আছে।

ভারতের বিপক্ষে আগের ম্যাচে দুর্ভাগ্যক্রমে ২-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল নিজেদের প্রমাণের। সে ম্যাচে দারুণভাবেই উৎরে যান বাংলাদেশের ফুটবলাররা, ‘মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটিতে আমরা ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। জয় আমাদের পেতেই হবে। দারুণ খেলেই আমরা ম্যাচটা জিতেছিলাম। মালয়েশিয়া প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে আশীষ গোলটি শোধ করে। দ্বিতীয়ার্ধে আমার পা থেকে আসে জয়সূচক গোলটি।’

বাদল রায় বলেন, ‘বিরাশির এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের কোচ ছিলেন একজন জার্মান। গেরহার্ড স্মিথ। অসাধারণ একজন কোচ। তাঁর অধীনে দারুণ প্রস্তুতি ছিল আমাদের। প্রস্তুতির তুলনায় প্রাপ্তিটা তেমন ছিল না। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি আমাদের জেতা উচিত ছিল। তবে ভারতও কিন্তু খুব ভালো দল ছিল। নিজেদের মাঠে এশিয়াড দেখে ভালো করার লক্ষ্যে তারা প্রস্তুতি শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই।’

চীনের বিপক্ষে ম্যাচটিও বাদল রায়ের কাছে দারুণ স্মরণীয়, ‘চীনের বিপক্ষে গোলটা আমরা খেয়েছিলাম প্রথমার্ধেই। এরপর পুরো খেলায় ছিল আমাদের দাপট। প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি গোলের সুযোগ আমরা নষ্ট করেছিলাম। অনেক উঁচুতে লাফিয়ে একটি বলে হেড করতে গিয়ে সে ম্যাচে আসলামের মাথা ফেটে গিয়েছিল, মনে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল যে ম্যাচটা শেষ অবধি চীন জিততে পেরেছিল।’

ইনচন এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ভালো করুক এটা বাদল রায়ও চান। কিন্তু এশীয় পর্যায়ে ভালো করার মতো খেলোয়াড় দলে নেই বলেই তাঁর অভিমত। তার পরও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়টা তাঁর প্রত্যাশাই, ‘আমি চাই দল অন্তত আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিতে আসুক। ডাচ কোচ চেষ্টা করেছেন দলটাকে দাঁড় করাতে। তাঁকে একটু সময় দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ভালো মানের খেলোয়াড় তো তেমন নেই। মামুনুলকে খুব ভালো খেলতে হবে। উজবেকিস্তানের সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। হংকংকে তো আমরা সাম্প্রতিক অতীতে হারিয়েছি। বছর কয়েক আগে পারলে এবার নয় কেন? আমি মনে-প্রাণেই চাই দল ভালো করুক। এ দেশের ফুটবল আবার ফিরে পাক প্রাণ। খেলায় দর্শক ফেরাতে, আগ্রহ ফেরাতে আন্তর্জাতিক সাফল্যের বিকল্প নেই।’