আজ ফুটবলকে 'বাঁচানোর' ভোট

.
.

‘সিল মারো ভাই সিল মারো’র স্লোগান নেই। ‘ভোট দেবেন না কলাগাছে, একটি ভোটের মূল্য আছে’র মাইকিংও কানে এসে বাজবে না। তবে আজ জুরিখে অনুচ্চারে হলেও যে এই স্লোগানগুলো বাজবে। বিশেষ করে দ্বিতীয়টি। ফিফা তার ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সামনে দাঁড়িয়ে আজ। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা, প্রাসাদবাসী পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি থেকে ঘরহীন পথের মানুষটার স্বপ্ন জড়িয়ে যে খেলার সঙ্গে, সেই মরমর স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখার ভোট আজ। ফুটবলকেই বাঁচানোর ভোট আজ।
মাঠে ফুটবল যখন তার ইতিহাসে সবচেয়ে সোনালি সময়গুলোর একটি পার করছে, লিওনেল মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের দুই সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ফুটবলকে যখন নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন; সেই সময় সেপ ব্ল্যাটার-মিশেল প্লাতিনিরা মাঠের বাইরে ফুটবলটিকে এগিয়ে নিতে গিয়ে উল্টো নিয়ে ফেলেছেন দুর্নীতির পাকে। ভেতরে-ভেতরে ফুটবল প্রশাসনে যে ঘুণে ধরেছে, এর ক্ষত ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শরীরে; কেউই জানেনি।
জানেনি বলেই দগদগে সেই ক্ষত অকস্মাৎ বাইরে এসে পড়ায় চমকে গেছে সবাই। আজ সেই ক্ষত সারিয়ে তোলারও ভোট। ফিফার সদর দপ্তরে এর আগেও অনেক কংগ্রেস হয়েছে। কিন্তু আজ ফিফার যে নবম সভাপতি নির্বাচিত হবেন, তাঁর কাছে গুরুভার ফুটবলকে বাঁচানোর। ফুটবলের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার। ফিফার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনার। ২০৭টি ভোটের প্রতিটিই আজ তাই মহামূল্যবান।
ফিফার মোট সদস্য অবশ্য ২০৯টি। এ কারণেই ফিফাকে বলা হয় জাতিসংঘের চেয়েও বড় সংগঠন। আজ অবশ্য দুটি সদস্য ভোট দিতে পারছে না ফেডারেশনে সরকারি হস্তক্ষেপে তাদের সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত রাখা হয়েছে বলে—কুয়েত ও ইন্দোনেশিয়া। বাকি ২০৭ ফেডারেশন-প্রধান ভোট দেবেন তাঁদের পছন্দের সভাপতিকে বেছে নিতে। যে পদে লড়াই করছেন পাঁচজন। যদিও মূল লড়াইটা সুইজারল্যান্ডের জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ও এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের সভাপতি বাহরাইনের শেখ সালমান বিন ইব্রাহিম আল-খলিফার মধ্যে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ধনকুবের টোকিও সেক্সওয়েল, ফিফার সাবেক মহাসচিব ফ্রান্সের জেরোম শ্যাম্পেন ও সর্বশেষ নির্বাচনে ব্ল্যাটারের প্রতিদ্বন্দ্বী জর্ডানের প্রিন্স আলী বিন আল হোসেন লড়ছেন এই ভোটে। যদিও শেষের তিনজনকে মনে হচ্ছে পার্শ্বচরিত্রই। পাঁচ প্রার্থীর দুজন এশিয়ার হলেও এই মহাদেশ থেকে ফিফার সভাপতি এর আগে কেউ নির্বাচিত হয়নি। বস্তুত ইউরোপের বাইরে ফিফা সভাপতি হয়েছিলেন একজনই—ব্রাজিলের হোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ।
এর মূল কারণ ইউরোপ আর আফ্রিকার ভোটসংখ্যা, সেই সঙ্গে এই দুই কনফেডারেশনের ফুটবলীয় সম্পর্ক। ইউরোপের (উয়েফা) ৫৩ ভোট, আফ্রিকার (সিএএফ) ৫৪টি। তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট এশিয়ার (এএফসি) ৪৬টি, যার দুটি আবার এবার ভোট দিতে পারছে না। উত্তর ও মধ্য আমেরিকা (কনক্যাকাফ) ৩৫টি। ওশেনিয়া (নিউজিল্যান্ড ও পার্শ্ববর্তী) ১১ ও দক্ষিণ আমেরিকা (কনমেবল) ১০টি। ওশেনিয়া, কনক্যাকাফ, কনমেবলও ইউরোপীয় প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে থাকে। সত্যি বলতে কী, আগের নির্বাচনে এশিয়ার প্রার্থী প্রিন্স আলী এশিয়ারও নিরঙ্কুশ সমর্থন পাননি। এশিয়ার কারও ফিফার সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার এবারই সেরা সুযোগ।
ফিফা সভাপতি হতে গেলে মোট ভোটের দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে। অর্থাৎ জেতার জন্য কোনো প্রার্থীকে ২০৭ ভোটের ১৩৮টি পেতে হবে। সেটি না পেলে দ্বিতীয় দফায় ভোট হবে। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই হবে। অর্থাৎ ভোট লাগবে ১০৪টি। তবে আজকের কংগ্রেসের আগে কুয়েত ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠেও যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে ২০৯টি সদস্যদেশই ভোট দেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবও তখন বদলে যাবে।
ভোটের এই সমীকরণের জন্যই শুধু নয়, এবারের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আরও একটি কারণে। এবারের কংগ্রেস আক্ষরিক অর্থেই ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ হয়ে উঠছে ফিফার কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবের কারণে। ফিফায় আরও বেশি জবাবদিহি, ফিফা সভাপতির একচেটিয়া ক্ষমতা হ্রাস করার মাধ্যমে ভোট-বাণিজ্য বন্ধ করা, বিশ্বকাপের স্বাগতিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় আরও বেশি স্বচ্ছতা আনা, বড় স্পনসরদের সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের চুক্তিগুলোতেও স্বচ্ছতা নিয়ে আসা—ফিফার ক্ষত সারাতে আনা হয়েছে বেশ কিছু প্রস্তাব। কংগ্রেসে এই প্রস্তাবগুলো অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে।
ফিফার আজকের কংগ্রেস ও নির্বাচন তাই সত্যিই শেষ পর্যন্ত কোনো সাধারণ নির্বাচন নয়। নির্বাচনের চেয়েও বেশি কিছু!