আবাহনীকে নতুন করে ভাবতে হবে

আবাহনীকে নতুন করে দল নিয়ে ভাবতে বললেন দলের পর্তুগিজ কোচ লেমোসছবি: প্রথম আলো

২০১৮ ফেডারেশন কাপে স্থানীয় কোচের অধীনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী লিমিটেড। এরপরই তরুণ পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস এএফসি কাপে আকাশি-নীলদের প্রথমবার নিয়ে যান আন্ত–আঞ্চলিক টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে, লেমোসের বয়স তখন ছিল মাত্র ৩২। কিন্তু দারুণ ওই সাফল্যের পর লেমোসের আবাহনী থুবড়ে পড়ে ঘরোয়া ফুটবলে। একটি স্বাধীনতা কাপ এবং দুটি করে ফেডারেশন কাপ ও লিগে টানা ব্যর্থ। বসুন্ধরা কিংসের দাপটে ম্রিয়মাণ আবাহনী এবারের লিগে সম্ভবত তৃতীয় হচ্ছে। কেন এই দুরবস্থা? গতকাল সন্ধ্যায় অনুশীলনের পর ধানমন্ডি আবাহনী ক্লাব ভবনে প্রথম আলোর মুখোমুখি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশের তরুণ কোচ।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: প্রিমিয়ার লিগ প্রায় শেষ। ২৪ মাচের লিগে চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের পয়েন্ট ২১ ম্যাচে ৫৮। শেখ জামাল ২২ ম্যাচে ৪৬। আবাহনী ২২ ম্যাচে ৪৩। কীভাবে মূল্যায়ন করবেন নিজ দলের এই অবস্থান?

মারিও লেমোস: আমি খুবই হতাশ এবং ব্যথিত। বসুন্ধরা কিংস একতরফা টানা ৫টি ট্রফি নিয়ে গেল। ওরা অনেক বিনিয়োগ করে এগোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা নিজেদের সেরাটা দিতে পারিনি মাঠে। নানা কারণে পিছিয়ে পড়েছি।

অবশ্যই দায় আমার এবং আমি দায় নিচ্ছি। সত্যি বলতে আমি ভীষণ দুঃখিত। আসলে এবার চোট সমস্যা আমাদের শেষ করে দিয়েছে।
এবারের লিগে আবাহনীর ব্যর্থতা নিয়ে কোচ লেমোস
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: টানা ৫টি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে আবাহনীর এই ব্যর্থতায় কোচ হিসেবে আপনার দায় কতটা?

লেমোস: অবশ্যই দায় আমার এবং আমি দায় নিচ্ছি। সত্যি বলতে আমি ভীষণ দুঃখিত। আসলে এবার চোট সমস্যা আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আক্রমণে চোটগ্রস্ত নাবিব নেওয়াজ জীবনকে লিগের প্রথম ম্যাচের পর থেকেই আর পাইনি। সোহেল রানা, সাদ, রায়হানরা চোট নিয়ে খেলতে পারেনি কিছু ম্যাচ। তা ছাড়া প্রথম পর্বে ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার তোরেস প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে না পারায় ওকে মাঝপথে বিদায় দিয়েছি। সবচেয়ে বড় হতাশার, চোটের হানায় টানা দুই ম্যাচে আমরা সেরা একাদশটা পাইনি।

আবাহনী নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন পর্তুগিজ কোচ লেমোস
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: কিন্তু আবাহনীতে এত চোট কেন? তাহলে কি প্রাক্‌–মৌসুম কন্ডিশনিং ক্যাম্প ভালো হয়নি?

লেমোস: দেখুন, চোট হতেই পারে। তবে এত ব্যাপক হারে কেন, সেটা আমি বুঝতে পারছি না। প্রতি ম্যাচের আগে দেখা গেছে ৩–৪ জনের চোট। ফলে বাধ্য হয়ে রাইটব্যাকে আমি চার-চারজনকে খেলিয়েছি! সাদ, মামুন মিয়া, নাসির ও রায়হান। লেফটব্যাকে ওয়ালী, রায়হান, নাসির। রক্ষণে একই খেলোয়াড় একই পজিশনে দলের জন্য ভালো। নইলে অনেক সমস্যা হয়।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আবাহনীর মাঠের ছন্দোবদ্ধ খেলা উধাও। কোথাও কি মনে হয় না আবাহনী তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে?

লেমোস: বাস্তবতা হচ্ছে ডিম যেমন, অমলেটও তেমন হবে। অর্থাৎ যেমন খেলোয়াড় তেমন ফল। লিগে দেখুন আমরা সাত-সাতটি ম্যাচ ড্র করেছি। তিনটি হেরেছি। বসুন্ধরার লিগে একটি ড্র, একটি হার। আমরা জেতা ম্যাচ ড্র করেছি। সর্বশেষ ৫ ম্যাচে আমরা ৮ পয়েন্ট হারিয়েছি। এগুলো মেনে নেওয়া কষ্টকর।

বয়সী খেলোয়াড় যে কজন থাকা উচিত একটা দলে, তার চেয়ে আমাদের অন্তত ৫–৬ জন বেশি। ফলে তাদের কাছ থেকে সেভাবে ভালো খেলাটা আমরা পাইনি। চোটের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের বয়সও আমাদের ভুগিয়েছে, এটা সত্যি।
আবাহনীর খেলোয়াড়দের বেশি বয়স, এ অভিযোগের জবাবে লেমোস
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: এই বিপর্যয়ের জন্য ক্লাব ব্যবস্থাপনা কতটা দায়ী?

লেমোস: ক্লাবের কোনো দায় নেই। ক্লাব সর্বোচ্চ সুযোগ–সুবিধা দিয়েছে। সমস্যা হয়েছে মাঠের পারফরম্যান্সে। মুক্তিযোদ্ধার মতো দলের কাছে ৪–২ গোলে হেরেছি। ঈদের পর সাইফের কাছে ৩–২ গোলে হার, শেখ জামালের সঙ্গে ২–২। নিজেদের ভুলে শিশুতোষ সব গোল খেয়েছি।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আবাহনী পেশাদার লিগের ১৪ বছরের ইতিহাসে এর আগে ২০১৮-১৯ মৌসুমে সর্বোচ্চ ২৮ গোল খেয়েছে। এবার এখন পর্যন্ত ২২ ম্যাচে ২৮টি, এর ১১টিই সর্বশেষ ৫ ম্যাচে। রক্ষণেই কি মূল সমস্যা?

লেমোস: অনেক বড় সমস্যা। শেষ মিনিটে গোল খেয়ে ড্র করেছি। তবে এতে গোলকিপার সোহেলের দোষ দেব না। আসলে আমাদের রক্ষণে ধারাবাহিকতার অভাব ছিল তীব্র।

খেলোয়াড়দের নিয়ে ছক সাজাচ্ছেন আবাহনী কোচ মারিও লেমোস। ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: কিন্তু আবাহনীকে অনেকে বলছেন বুড়োদের দল। আপনি কী বলবেন?

লেমোস: বয়সী খেলোয়াড় যে কজন থাকা উচিত একটা দলে, তার চেয়ে আমাদের অন্তত ৫–৬ জন বেশি। ফলে তাদের কাছ থেকে সেভাবে ভালো খেলাটা আমরা পাইনি। চোটের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের বয়সও আমাদের ভুগিয়েছে, এটা সত্যি।

হ্যাঁ, অ্যান্ড্রু ওর্ডের সঙ্গে আমি থাইল্যান্ডে সহকারী কোচ ছিলাম ক্লাব পর্যায়ে। ওর্ড বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে এলে ও আমাকে বাংলাদেশ দলের ট্রেইনার হিসেবে নিয়ে আসে। সেই সূত্রেই পরে আবাহনীতে এসেছি। আগামী মৌসুমেও এই ক্লাবে থাকতে চাই। যদিও ক্লাবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে এখনো কথা হয়নি।
মারিও লেমোস, আবাহনী কোচ
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় লিগের দ্বিতীয় পর্বে ফিরিয়ে আনা পুরোনা স্ট্রাইকার সানডে সিজোবা কেমন করলেন?

লেমোস: ৯ ম্যাচে সে ৮ গোল করেছে। ভালোই বলব।

আবাহনীর পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস। ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনার অধীনে বসুন্ধরার সঙ্গে সর্বশেষ ৫ ম্যাচেই হেরেছে আবাহনী। কীভাবে চ্যাম্পিয়নদের সামলাবেন ভবিষ্যতে?

লেমোস: সামনের মৌসুমের দলে বেশি বয়সী খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা দরকার। অন্তত বেশি বয়সীদের মধ্যে ৫–৬টি বদল চাই। আসলে আগামীর চ্যালেঞ্জ নিতে আবাহনীকে নতুন করে ভাবতে হবে। এবার তরুণ হৃদয়, দীপকরা ভালো করেছে। সঙ্গে নবীন কিছু খেলোয়াড় নিতে হবে। অভিজ্ঞ ও নবীনের মিশ্রণ ঘটানো এখন সময়ের দাবি। নইলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ভবিষ্যতে আরও কঠিন হয়ে যাবে।

প্রশ্ন :

বসুন্ধরা কিংসের কাছে টানা ৫টি ম্যাচ হারের পর কী ভাবছেন। সামনে কী অপেক্ষা করছে?

লেমোস: ২০১৮ সালে স্বাধীনতা কাপের সেমিতে টাইব্রেকারে হেরেছি বসুন্ধরার কাছে। এ পর্যন্ত লিগে হেরেছি তিন বার। ফেডারেশন কাপে অতিরক্তি সময়ে একবার। তবে ওদের হারানো সম্ভব। সেই চেষ্টাই করব বসুন্ধরার সঙ্গে এবারের লিগের শেষ ম্যাচে।

প্রশ্ন :

এই লিগে কার খেলা ভালো লেগেছে? এক নম্বরে রাখবেন কাকে?

লেমোস: বসুন্ধরা কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবসন দ্য সিলভা দারুণভাবে নজর কেড়েছে। আমাদের ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার রাফায়েল, সোহেল রানার কথা বলতে পারি। আরও বেশ কয়েকজন আছে।

প্রশ্ন :

মাত্র ৩১ বছর বয়সে আপনি মালয়েশিয়ায় প্রিমিয়ার লিগে একটি দলের কোচ হয়েছেন। এখন আপনার বয়স ৩৫। এত অল্প বয়সে আবাহনীর মতো দলের কোচের দায়িত্ব পালন কতটা চাপের?

লেমোস: অনেক চাপের। কারণ, আবাহনী ক্লাবের মর্যাদাই আলাদা। তবে সেই মর্যাদা সমুন্নত রেখেই দল পরিচালনা করতে চেয়েছি আমি। বিভিন্ন কারণে ফল হয়তো খারাপ হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার সেরাটাই দিয়েছি।

প্রশ্ন :

অনেক বলেন, আপনার বয়স কম। ফলে খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর আপনার জন্য। এটা কী কোনো সমস্যা তৈরি করছে?

লেমোস: মালয়েশিয়ায় প্রিমিয়ার ডিভিশনে আমি নিচের দিকের দল নেগরি সেমবিলানের প্রধান কোচ ছিলাম। প্রধান কোচ হিসেবে সেটিই ছিল আমার প্রথম দায়িত্ব। সেই দলটিতে ৮ মাস ছিলাম। আমরা সম্ভবত ১১তম হই লিগে। ওই সময়ে দুজন কোচ বরখাস্ত করে ওরা আমাকে নিয়েছিল। মালয়েশিয়ায় তখন অনেকে বলত, '' লেমোস এত তরুণ। সে কেন? সে কীভাবে টিম সামলাবে।'' বাংলাদেশেও কথাটা শুনেছি, তবে কম। ঘটনা হলো, এই কথাটা শুনলে আমার জেদ বাড়ে। আমি আত্মবিশ্বাসী হই। আসলে এটাই আমাকে এত দূর এনেছে।

প্রশ্ন :

পুর্তগালে জন্ম আপনার। এত অল্প বয়সে শীর্ষ স্তরে কোচ হলেন কীভাবে?

লেমোস: তরুণ বয়সে আমি পর্তুগালে তৃতীয় বিভাগে খেলেছি। তখনই বুঝতে পেরেছি ফুটবলার হিসেবে বেশি দূর যেতে পারব না। তাই মাত্র ২১-২২ বয়সেই আমি কোচ হতে চেয়েছি। লক্ষ্য ছিল ভালো কোচ হওয়া। এরই মধ্যে উয়েফা 'এ' কোচিং সনদ নিয়েছি। এখন বাংলাদেশেই উয়েফা প্রো কোচিং কোর্স করছি।

প্রশ্ন :

রোনালদোর সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছে?

লেমোস: না, হয়নি। ওর জন্ম একটা আইল্যান্ডে। আমি পর্তুগালের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ। তবে নানির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তরুণদের একটি ফুটবল ক্লিনিকে আমি আর নাকি একসঙ্গে কাজ করেছি থাইল্যান্ডে।

প্রশ্ন :

থাইল্যান্ডে কাজ করার সুবাদেই ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসার দরজা খোলে আপনার সামনে...

লেমোস: হ্যাঁ, অ্যান্ড্রু ওর্ডের সঙ্গে আমি থাইল্যান্ডে সহকারী কোচ ছিলাম ক্লাব পর্যায়ে। ওর্ড বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে এলে ও আমাকে বাংলাদেশ দলের ট্রেইনার হিসেবে নিয়ে আসে। সেই সূত্রেই পরে আবাহনীতে এসেছি। আগামী মৌসুমেও এই ক্লাবে থাকতে চাই। যদিও ক্লাবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে এখনো কথা হয়নি।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে আপনার কেমন লাগে?

লেমোস: ভালো, কোনো সমস্যা নেই ( আবাহনী ক্লাব ভবনে সন্ধ্যায় পরোটা খেতে খেতে) । বাংলাদেশে আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার পরোটা আর মাংস। প্রতি সকালে আমি এটা খাই। সঙ্গে ভাজি ( হাসি)।