আমাদের জার্সির গল্পটা অনেক রঙিন
গত বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি নিয়ে সে কী তোলপাড়! লাল-সবুজ পতাকার দেশের জাতীয় দলের জার্সিতে সবুজ রং থাকলেও নেই লাল। ব্যাপারটা রীতিমতো জাতীয় সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ফেসবুক-টুইটারে তীব্র সমালোচনার পর অফিশিয়াল ফটোসেশনের পরেও জার্সির নকশা বদলাতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। লাল-সবুজের ছোঁয়া লাগা জার্সি পরেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে খেলেছিল সাকিব-তামিমরা।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে জার্সিতে লাল-সবুজ রং নিয়ে যখন হইচই তুঙ্গে তখন একটু পুরোনো ফুটবলপ্রেমীরা হেসেছেন মুখ টিপে। এ হাসির কারণ খুবই বোধগম্য। একটা সময় যে জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে লাল-সবুজের ছোঁয়াই ছিল না। এ প্রজন্ম আরও অবাক হতে পারে আরও একটি তথ্যে—১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জার্সি ছিল গোলাপি রঙের। স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনুসরণে গোটা সত্তরের দশকেই জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি ছিল গোলাপি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য জাতীয় পতাকার রং আনা হয় জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে।
জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সি নিয়ে হয় অনেক আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু এর কানাকড়িও হয় না জাতীয় ফুটবল দলের জার্সি নিয়ে। কেউ জানেই না অতীতে কেমন রং, কেমন নকশার জার্সি পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলেছে বাংলাদেশ। এই লেখার মাধ্যমে জাতীয় দলের জার্সির ইতিহাসে যদি একটু চোখ ফেরানো যাক। এ দেশে যেকোনো কিছুতেই তথ্য-উপাত্ত যত্ন করে সংরক্ষণ করে রাখার সংস্কৃতিটা খুব জোরালো নয়। সংশ্লিষ্টরা এসবের ধারই ধারেন না। অথচ, বিদেশে অনেক সময়ই জাতীয় দলের পুরোনো ডিজাইনের জার্সি নতুন করে সামনে নিয়ে আসা হয়, সেগুলো নিয়ে হইচই হয়। ফ্যাশন হাউজগুলো সেসব জার্সির রেপ্লিকা বিক্রি করে, মানুষও কেনে হটকেকের মতো।
রেকর্ডপত্র ধরে রাখার ব্যবস্থা যেহেতু নেই, তাই বিভিন্ন পুরোনো ছবি ঘেঁটে প্রথম আলোর অনলাইন ক্রীড়া বিভাগ নিজেরাই এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের ৩৫টি বিভিন্ন ডিজাইনের জার্সি এ প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের সামনে তুলে ধরার একটা চেষ্টা করেছে। এগুলো হুবহু আসল জার্সির মতো, সে দাবি আমরা করছি না। তবে ছবি-টবি দেখে নকশা ও রং কাছাকাছি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ রেকর্ড না রাখুক, এ দেশের জাতীয় ফুটবল দলের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা অন্তত ৩৫টি জার্সির নমুনা সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে প্রথম আলোর আর্কাইভে। আজ রাতে ওমানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচটির আগে এই জার্সিগুলো ফুটবলপ্রেমীদের ভালোবাসাটা আরও জাগিয়ে তুলবে—এটা আশা করাই যায়।

এ পর্যন্ত একবারই এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। ১৯৮০ সালে কুয়েতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপে যে দুই রং ও নকশার জার্সি পরে বাংলাদেশ খেলেছিল, সে দুটি দিয়েই আমরা জার্সির গল্পটা শুরু করেছি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জার্সির ডিজাইনটা হুবহু করতে চাইলেও তেমন কোনো প্রামাণ্য দলিল আমরা পাইনি, যেটি দেখে এর রেপ্লিকা তৈরি করা যায়। সে কারণে আমরা সেটি বাদ দিয়েছি। সত্তরের দশকের জার্সিগুলোর কোনো রঙিন ছবি না থাকায় আমরা সেগুলোও বাদ দিয়েছি বাধ্য হয়ে।
১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপে বাংলাদেশ পরেছিল কমলা ও সাদা রঙের জার্সি। কমলা জার্সিটাই ছিল মূল জার্সি, অ্যাওয়ে হিসেবে ছিল সাদা রঙেরটা। ১৯৮২ সাল দিল্লি এশিয়ান গেমসের তিনটি ম্যাচের যে ছবি আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যাচ্ছে ভারত, চীন ও মালয়েশিয়া—এই তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশ পরেছিল কমলা রঙের জার্সি। বুকে এমব্রয়েড করা ছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের লোগো।

এরপর দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সাদা ও লাল রঙের জার্সি ব্যবহার করেছে। হোম লাল, অ্যাওয়ে সাদা। বুকে ছিল জাতীয় পতাকা। ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বেশির ভাগ ম্যাচেই বাংলাদেশ পরেছিল লাল রঙের জার্সি। কয়েকটি ম্যাচে ছিল সাদা। একই বছর ঢাকা অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় সাফ গেমসে বাংলাদেশ প্রতিটি ম্যাচেই পরেছিল ফুলস্লিভ লাল জার্সি। এবার একটি পরিবর্তন আসে। লাল শর্টসের জায়গায় আসলাম-জনি-আশিস ভদ্ররা পরেছিলেন সাদা শর্টস। মোজা ছিল সেই লালই।
জাতীয় পতাকার সবুজ রং বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে লাগে অনেক পরে। ১৯৯০ সালের আগে যে কটি জার্সির অস্তিত্ব পাওয়া যায়, সেগুলোতে সবুজ রং ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৯০ বেইজিং এশিয়ান গেমসে দুই জার্সি ছিল সবুজ। অন্যটি লাল। সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ পরেছিল লাল জার্সি, জাপানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে সবুজ।
আশির দশকে লাল-সাদা জার্সির আধিক্য ছিল। নব্বইয়ের দশকে সবুজ রঙের পাশাপাশি ফিরে আসে কমলা রং। ১৯৯১ কলম্বো সাফ গেমস, ১৯৯২ এশিয়ান কাপ বাছাই, ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, ১৯৯৫ মিয়ানমার চার জাতি ফুটবল, ১৯৯৫ মাদ্রাজ সাফ গেমস, ১৯৯৭ বিশ্বকাপ বাছাই—প্রায় প্রতিটি টুর্নামেন্টেই দুটি জার্সির একটি ছিল কমলা। তবে গোটা নব্বইয়ের দশকজুড়েই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ‘অল হোয়াইট’ জার্সির স্মৃতিটাই বেশি জাগরুক ক্রীড়াপ্রেমীদের মনে।

১৯৯৯ সালে গোয়া সাফ ফুটবলে অদ্ভুত ব্যাপার হয়। বাংলাদেশকে নীল জার্সিতে প্রথমবারের মতো দেখা যায়। নেভি ব্লু জার্সি, সবুজ শর্টস। অনেকেরই হয়তো স্মৃতিতে আছে, সেবার সে জার্সি নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। তবে সমালোচনায় কান না দিয়েই বাফুফে সে সময় ‘নেভি ব্লু’প্রীতিতে মেতে ওঠে। ১৯৯৯ সালে আবুধাবিতে এশিয়ান কাপ বাছাইতে নেভি ব্লু জার্সি ছিল একটি। ১৯৯৯ বঙ্গবন্ধু কাপে বাংলাদেশকে হলুদ জার্সি পরতে দেখা যায়। তবে এই হলুদ জার্সি ছিল ১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও। ১৯৯৯ সালে হলুদ জার্সিতে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল অনেকটাই ‘সুইডেন’ চেহারায় আবির্ভূত হয়েছিল।
২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের জার্সিতে এই নেভি ব্লু রংটা আবারও দেখা যায়। সাদা জার্সির মধ্যে নেভি ব্লু ও লাল বর্ডার। শর্টস, মোজা দুই সাদা—এই জার্সি পরে বাংলাদেশ জিতেছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। ২০০০ সালের পর সবুজ ও লাল রংকেই জাতীয় দলের জার্সির ‘স্ট্যান্ডার্ড’ রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। তবে শর্টস ও মোজায় সাদা রংটা থেকে গেছে প্রায় সব সময়ই।
ক্রীড়া সামগ্রীর দোকানে বিভিন্ন দেশের জার্সি পাওয়া যায়। ক্রিকেটের জার্সি তো সর্বাধিক বিক্রীত। এই প্রজন্মের প্রিয় ফ্যাশন পণ্যের তালিকায় থাকে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, লিভারপুলসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবের জার্সি। ইদানীং বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিও খুব বিরল কিছু নয়। হালে ফুটবলের চাকা একটু একটু করে যেভাবে ঘুরতে শুরু করেছে, তাতে কে জানে এ দেশের ফুটবলের এই স্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া জার্সি গুলোই হয়তো একদিন জায়গা করে নেবে ক্রীড়াপ্রেমীদের ফ্যাশন তালিকায়। সে দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়। অপেক্ষায় তো থাকাই যায়।