এই চ্যালেঞ্জ জিততে রোনালদো জুভেন্টাসে এসেছিলেন?

জুভেন্টাসে এসে লক্ষ্যপূরণ হয়নি রোনালদোরছবি: রয়টার্স

‘টাকার জন্য ক্লাব ছাড়লে তো চীনের যেতে পারতাম। এখানে যা কামাচ্ছি, তার থেকে আরও পাঁচ গুণ বেশি কামাতে পারতাম। আমি জুভেন্টাসে টাকার জন্য আসিনি। আমি মাদ্রিদেও এর চেয়ে বেশি না হলেও প্রায়ই একই টাকা উপার্জন করতাম।’

কথাটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে যখন জুভেন্টাসে নাম লেখালেন, বড় মুখ করে বলেছিলেন এই কথা। সাফ জানিয়েছিলেন, টাকাপয়সা কামানোর জন্য জুভেন্টাসে নাম লেখাননি। তাঁর বয়স তখন ৩৩, যে বয়সে আসার পর বিশ্বের অনেক খেলোয়াড়ই ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছেড়ে পাড়ি জমান চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে। খেলোয়াড়ি জীবন যতটুকু বাকি আছে, ততটুকু সময়ে যত বেশি কামানো যায়—লক্ষ্যটা এমনই। কিন্তু রোনালদো তো আর দশটা খেলোয়াড়ের মতো নন।

চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়ের হতাশায় রোনালদো
ছবি: রয়টার্স

এই বয়সেও নতুন চ্যালেঞ্জ জয়ের জন্য টগবগ করতে থাকে তাঁর রক্ত। যে কারণে বাড়তি টাকার লোভ নয়, বরং এই বয়সে জুভেন্টাসে গিয়ে দলটাকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্নই তাড়িয়ে ফিরছিল তাঁকে। ১৯৯৬ সালের পর থেকে মহাদেশসেরা হওয়ার স্বাদ না পাওয়া জুভেন্টাসও প্রতিযোগিতাটার সফলতম খেলোয়াড়টিকে দলে এনে বুনতে শুরু করেছিল নতুন স্বপ্ন। সে কারণেই রোনালদো যখন চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলেন, কেউ হালকাভাবে নেয়নি। সারা জীবন সংশয়বাদীদের মুখ বন্ধ করে সফল হয়েছেন যে তারকা, তাঁর কথা হালকাভাবে কীভাবে নেওয়া যায়?

সবাই তাই অপেক্ষায় ছিল, জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে রোনালদো তাঁর এই ‘চ্যালেঞ্জ’ কবে পূরণ করতে পারেন। এই বয়সে এসে কবে জুভেন্টাসকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাদেশসেরা বানাতে পারেন রোনালদো। এক বছর গেল, দুবছর শেষ হলো, তিন বছর শেষ হলো—কিন্তু চ্যালেঞ্জটা আর পূরণ করা হলো না রোনালদোর। প্রথমে আয়াক্স, গত বছর লিওঁ, এবার এফসি পোর্তো—রোনালদো ফিরলেন খালি হাতে। প্রশ্ন তাই উঠেছে, রোনালদোর জুভেন্টাস-অধ্যায় ঠিক কতটুকু সফল?

রোনালদো আসার আগের তিন মৌসুমের মধ্যে দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছিল জুভেন্টাস। একবার হেরেছিল বার্সেলোনার কাছে, একবার রোনালদোর সাবেক ক্লাব রিয়ালের কাছে। রোনালদো নিজেই জুভেন্টাসকে বিদায় করার জন্য যা করার, সব করেছিলেন। রোনালদোকে দলে আনার পেছনে জুভেন্টাসের লক্ষ্য ছিল, ফাইনালের এই গেরোটা কোনোভাবে কাটানো। কিন্তু ফাইনাল-গেরো কাটাবেন কি, রোনালদো তিন বছরে জুভেন্টাসকে এখনো সেমিফাইনালেই তুলতে পারলেন না!

প্রথম বছর আয়াক্সের হাতে বিদায়টা ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে, তার পরের দুবার তো তা-ও নয়! গত বছর আর এ বছর জুভ বাদ পড়ল শেষ ষোলোতেই। এর আগে ইতিহাসে কখনো ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় টানা দুই বছর দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নেয়নি জুভেন্টাস! এই রেকর্ডের জন্য তো রোনালদোকে দলে টানেনি জুভেন্টাস!

যেদিন দরকার, সেদিনই জ্বলে উঠতে পারলেন না রোনালদো
ছবি: রয়টার্স

রোনালদো নিজেও যেন মহাদেশীয় এই প্রতিযোগিতায় গোল করা ভুলে গেছেন জুভেন্টাসে আসার পর থেকে। যে রোনালদো রিয়ালে নিজের শেষ মৌসুমেও চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৫ গোল করে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন, সে রোনালদো জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে এই তিন মৌসুমে গোল করেছেন সাকল্যে ১৪টি। প্রথম মৌসুমে ৬টি, পরের দুই মৌসুমে ৪টি করে।

ঝামেলা শুধু চ্যাম্পিয়নস লিগে যে, তা নয়। টানা ৯ বছর ঘরোয়া লিগের শিরোপা জিতছে জুভেন্টাস। রোনালদো আসার আগে সাত বছর, রোনালদোকে নিয়ে দুবছর। কিন্তু এবারই প্রথম এক দশকের মধ্যে ইতালি-সেরা না হওয়ার শঙ্কা জুভেন্টাসের সামনে। অর্থাৎ যে রোনালদোকে নিয়ে মহাদেশসেরা হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিল জুভেন্টাস, তাঁরা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা তো দূর, উল্টো ঘরের লিগের সেরাই হতে পারছে না! এই মুহূর্তে লিগে তিনে থাকা জুভের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে ১০ পয়েন্ট এগিয়ে শীর্ষে ইন্টার মিলান। লিগে জুভের ম্যাচ বাকি আর ১৩টি। অথচ রোনালদোকে নেওয়ার সময়েই বলাবলি হচ্ছিল, ঘরোয়া লিগ জিততে তো জুভেন্টাসের রোনালদোকে লাগে না, সেটা জুভ চোখ বন্ধ করেই জিততে পারে। এখন রোনালদোকে নিয়ে শত চেষ্টার পর লিগও হারানোর দশা!

এই মৌসুমে অবশ্য একটা শিরোপার খুব কাছে আছে জুভেন্টাস। কোপা ইতালিয়া! ফাইনালে উঠে গেছেন রোনালদোরা, যেখানে তাঁদের প্রতিপক্ষ আতালান্তা। জিতলে অন্তত মৌসুমের তিন শিরোপার একটি ঘরে আসবে, এই সান্ত্বনা জুটবে আন্দ্রেয়া পিরলোর দলের। কিন্তু রোনালদোকে দলে থাকার পরেও লিগ খুইয়ে, চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্যর্থ হয়ে, এই ‘কোপা ইতালিয়া’ দিয়ে জুভেন্টাস ভক্তরা কতটুকু খুশি হবেন? এমন খুশি কি তাঁরা চেয়েছিলেন?

নিঃসন্দেহে তাই বলা যায়, জুভেন্টাসে নাম লেখানোর পর থেকে এই মৌসুমটাই রোনালদোর জন্য সবচেয়ে বাজে হতে যাচ্ছে। দলগত অর্জনের দিক দিয়ে তো বটেই, ব্যক্তিগত অর্জন, কিংবা খেলার ধরনের ক্ষেত্রেও। কজন বলবেন, এখন রোনালদোর খেলা দেখে আগের মতো চোখের ওই শান্তিটা পাওয়া যায়?

রোনারদোকে বিক্রি করে দেবে জুভেন্টাস?
ছবি: রয়টার্স

বয়স ত্রিশ পেরোনোর পর থেকেই খেলার ধরনে বদল এনেছেন সিআর৭। উইং ছেড়ে বক্সে ওত পেতে থাকা শিকারি হয়ে গেছেন। তাঁর উচ্চতা আছে, বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের মতো লাফাতেও পারেন। বক্সে প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে গোল করার জায়গায় চলে যাওয়ার ক্ষমতা—যেটিকে অফ দ্য বল মুভমেন্ট বলে, তাতে রোনালদো অনন্য। রিয়ালে শেষ দিকে আর জুভেন্টাসে ওই ক্ষমতার বলেই গোলের পর গোল করে যাচ্ছেন রোনালদো। পরিসংখ্যান বলবে, ৩০-এর ডানে এসে গোলের সংখ্যায় তাঁর কাছাকাছি হয়তো শুধু ইব্রাহিমোভিচই আছেন!

কিন্তু খেলার ধরন বদলে এই যে গোলের পেছনে ছুটছেন রোনালদোর, সেটির বড় মূল্যও দিতে হচ্ছে। দলের খেলায় এখন আর রোনালদো তেমন অংশ নেন না। ফলে, ম্যাচে গোল না পেলে রোনালদোর ম্যাচে অবদান তেমন থাকে না। কাল যদিও জুভের একটা গোলে ‘অ্যাসিস্ট’ ছিল তাঁর। অ্যাসিস্ট বলতে ভেসে আসা বল নামিয়ে দারুণভাবে রেখেছেন গোলের পথে আসতে থাকা কিয়েসার দিকে, এই তো! কিন্তু ফুটবলপ্রেমী মন হয়তো রোনালদোর বল নিয়ে কারিকুরি, রোনালদোর গতির ঝলক, রোনালদোর জোরালো বা ‘নাকল’ ফ্রি-কিক দেখার ইচ্ছে নিয়েই বসে এখনো। তা কতটা পূরণ হয়?

ঝুঁকিটা জেনেশুনেই নিয়েছেন রোনালদো, রিয়ালে তাঁর সাবেক কোচ জিনেদিন জিদানের সঙ্গে পরামর্শ করেই নিয়েছেন। যাতে ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই তা করা। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, রোনালদোর ক্ষমতাটা কি ‘বয়স’ নামের মরচে পড়ছে?

গত রাতে পোর্তোর হাতে জুভেন্টাসের বিদায়ের ফলে আরেকটা প্রশ্নও উঠেছে তাই। তিন বছরেও জুভেন্টাসকে মহাদেশসেরা না বানাতে পারা রোনালদোর সঙ্গে জুভেন্টাসের চুক্তির আর বাকি আছে এক বছর। রোনালদো কি এই এক বছর জুভেন্টাসে থাকবেন? নাকি অন্য কোনো ক্লাবে নাম লেখাবেন? জুভেন্টাসই–বা কি রোনালদোকে দলে রাখবে?

ব্যাপারটা এমন না যে রোনালদো একটু অ-রোনালদোসুলভ খেলছেন বলে জুভেন্টাস তাঁকে দলে রাখতে চাইবে না। ও সাহস জুভেন্টাস কি, বিশ্বের অন্য কোনো ক্লাবেরই নেই। রোনালদো তো রোনালদোই। কিন্তু করোনাভাইরাস এসে যেভাবে গোটা ফুটবলবিশ্বের হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মাঠের খেলায় সফল না হলে রোনালদোকে বেতন দেওয়ার মতো ক্ষমতা এখনো জুভেন্টাসের আছে কি? গোটা স্কোয়াডের বেতন বাবদ জুভেন্টাসের খরচ হয় ২০ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডের মতো, যার মধ্যে রোনালদোকেই দিতে হয় ২ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ডের মতো। বন্ধ দরজার পেছনে দর্শকহীন মাঠে খেলার কারণে জুভেন্টাসের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খুব কম ক্লাবই হয়েছে। যাদের ম্যাচ ডে আয় বাবদ প্রায় ৩৬ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে, জানিয়েছে ডেলোয়েট ফুটবল মানি লিগ রিপোর্ট। চলতি মৌসুমের প্রথমার্ধের হিসাবে বের হয়ে এসেছে, এর মধ্যেই জুভেন্টাসের লোকসান হয়েছে প্রায় ১০ কোটি পাউন্ডের মতো।

এই ক্ষতি কমানোর জন্য রোনালদোকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যদি জুভেন্টাস নেয়ও, অমূলক কিছু হবে না। ইউরোপে গুঞ্জন তেমনই।