একসময়ের ‘দুধভাত’ মালদ্বীপই এখন বাংলাদেশের ‘দুঃখ’

২০০৩ সালে শেষবার মালদ্বীপকে হারিয়েছিল বাংলাদেশফাইল ছবি, এএফপি

অদ্ভুত এক প্রতিপক্ষ মালদ্বীপ। একসময় যে মালদ্বীপকে গোলে গোলে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ, সে মালদ্বীপই এখন এগিয়ে থাকা এক প্রতিপক্ষ। জনসংখ্যা কোটিও না ছোঁয়া, ভারত মহাসাগরের ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রই পরবর্তী সময় ফুটবলে এগিয়েছে অনেকটা পথ। মালদ্বীপকে অদ্ভুত প্রতিপক্ষ বলার একটা বড় কারণ হচ্ছে এ দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিসংখ্যান। যে দলকে একসময় ৮-০ গোলে হারিয়েছে বাংলাদেশ, সে দলই শেষবার বাংলাদেশকে হারিয়েছে ৫-০ গোলে। তাই এই দুই দলের মুখোমুখি হওয়া মানে সুখ-দুঃখ—দুই স্মৃতিরই অবতারণা। তবে মালদ্বীপ–দ্বৈরথের সাম্প্রতিক অংশটা পুরোপুরিই দুঃখের। আগামীকাল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের সঙ্গে আরও একটি ম্যাচ। সে ম্যাচের আগে দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের ইতিহাসটা সবাইকে মিশ্র এক অনুভূতির সঙ্গেই পরিচয় করাবে...

ঢাকায় গোলের বন্যা

১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেটি এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যায় ঢাকা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ফুটবলারদের যেন সেদিন গোলের নেশায় পেয়ে বসেছিল। শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ওয়াসিম ইকবাল, ইলিয়াস হোসেন, কায়সার হামিদরা সেদিন মনের সুখে মালদ্বীপের গোলবারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ‘নবিশ’ দল মালদ্বীপ সেদিন ছিল ছন্নছাড়া, অসহায়। এর আগেও একবার মালদ্বীপকে পেয়ে তাদের গোলবন্যায় ভাসিয়েছিল বাংলাদেশ। সেটি ১৯৮৪ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। সেবার গোল ব্যবধান ছিল ৫-০।

১৯৮৫ সাফ গেমসে বাংলাদেশের এ দলের বিপক্ষেই ৮ গোলে হেরেছিল মালদ্বীপ
ছবি: সংগৃহীত

দুঃখের শুরুটা যেখানে

১৯৯৩ সালের ষষ্ঠ সাফ গেমস। ঢাকায় সেবার দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত হয় সাফ গেমস। সুইজারল্যান্ডের কোচ ওল্ডরিখ সোয়াবের অধীনে বাংলাদেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়ে খেলতে নামে। গ্রুপে ছিল মালদ্বীপ ও নেপাল। প্রথম ম্যাচে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে (তখন মিরপুর স্টেডিয়াম ছিল কেবলই ফুটবলের) মালদ্বীপের মুখোমুখি হয় আরিফ হোসেন মুনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। মিরপুরে আরও একটি গোলবন্যার লক্ষ্য ছিল গোটা দলের। সাফ গেমসের কয়েক মাস আগেই ঢাকায় এশিয়ান ক্লাব কাপে (হালে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ) বাংলাদেশের প্রতিনিধি মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের মুখোমুখি হয়েছিল মালদ্বীপের ভ্যালেন্সিয়া এফসি। মালদ্বীপ জাতীয় দলের ৭ খেলোয়াড়ের ভ্যালেন্সিয়াকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল মোহামেডান। হ্যাটট্রিক করেছিলেন মোহামেডানের রাশিয়ান স্ট্রাইকার ওলেগ জিভৎনিকভ। সে ম্যাচকে প্রেরণা হিসেবে নিয়েই জাতীয় দল ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মুখোমুখি হয় মালদ্বীপের। মালদ্বীপ তখনো আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিতান্তই দুর্বল দল। বাংলাদেশের বিপক্ষে চরম রক্ষণাত্মক কৌশল নিয়ে খেলেছিল তারা। ৮ আট ৯ জন খেলোয়াড় সামলাচ্ছিলেন সে ম্যাচে মালদ্বীপের রক্ষণব্যূহ। আক্রমণের পর আক্রমণ করেও মালদ্বীপের রক্ষণ ভাঙতে পারছিল না বাংলাদেশ। ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের একটি গোল অফসাইডে বাতিল হয়ে যায়। অভিজ্ঞ কায়সার হামিদ পেনাল্টি মিস করেন। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত গোলশূন্যভাবে শেষ হয়। মালদ্বীপের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র আজ থেকে ২৮ বছর আগে বাংলাদেশের কাছে ছিল বিরাট বড় ব্যর্থতা। সে ব্যর্থতার জের কাটাতে না পেরেই হয়তো গ্রুপের শেষ ম্যাচে নেপালের কাছে ১-০ গোলে সাফ গেমস থেকে খালি হাতে বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ।

মালদ্বীপের আলী আশফাকের হাতেই ২০১১ সাফ হেরেছিল বাংলাদেশ
ফাইল ছবি

শক্তিশালী হয়ে উঠল মালদ্বীপ যেভাবে

১৯৯৩ সালের সেই গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু। এরপর ফুটবলে মালদ্বীপ ক্রমে এগিয়ে গেছে, পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সাফে মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে হারানোর পর বাংলাদেশ পরের ৫টি ম্যাচে মালদ্বীপকে হারাতেই পারেনি। উল্টো ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফের প্রথম ম্যাচে মালদ্বীপের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে যায় সোনাজয়ী বাংলাদেশ। ’৯৩-এর ঢাকা সাফের পর ড্র হয়েছে দুটি ম্যাচ—১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসে (০-০) আর ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে (১-১)। ২০০৩ সালে ঢাকায় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বে মালদ্বীপকে ১-০ গোলে হারানোর পর এই মালদ্বীপের বিপক্ষে আর কখনোই জিততে পারেনি বাংলাদেশ। যদিও ২০০৩ সাফের ফাইনালে মালদ্বীপকেই টাইব্রেকারে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ফিফার নিয়মে টাইব্রেকারে জয়কে তো ‘ড্র’ হিসেবেই ধরা হয়। একসময়ের ‘দুধভাত’ মালদ্বীপ এখন ফিফার তালিকাতেও বাংলাদেশকে বড় ব্যবধানেই পেছনে ফেলেছে।

দুই দলের মুখোমুখি লড়াই

আনন্দের শেষ স্মৃতি

২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের হাজার বিশেক দর্শকের সামনে দুর্দান্ত খেলল বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মালদ্বীপের বিপক্ষে একচেটিয়া ফুটবল খেলেও গোলের দেখা পাচ্ছিলেন না আলফাজ আহমেদ, রোকনুজ্জামান কাঞ্চনরা। গোলের সুযোগও নষ্ট হচ্ছিল বিস্তর। কয়েকটি সহজ সুযোগও। মালদ্বীপের বিপক্ষে আরও একটি জয়হীন ম্যাচ যখন দোরগোড়ায়, ঠিক তখনই গেরো খোলেন আরিফ খান জয়। ম্যাচের যোগ করা সময়ে তাঁর সুযোগসন্ধানী এক গোলেই ১৯৮৫ সাফের ১৮ বছরের মাথায় মালদ্বীপকে প্রথমবারের মতো হারায় বাংলাদেশ।

২০০৩ সালে মালদ্বীপকে টাইব্রেকারে হারিয়েই সাফের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ
ছবি: এএফপি

দুঃস্বপ্নের নাম আলী আশফাক

২০১১ সালে ভারতের দিল্লিতে বসে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। বাংলাদেশের গ্রুপে পাকিস্তান ও মালদ্বীপ। দিল্লির নেহরু স্টেডিয়ামে প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচে মালদ্বীপের বিপক্ষে রীতিমতো উড়ে যায়। সে ম্যাচে বাংলাদেশের বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন মালদ্বীপের কুশলী প্লে মেকার আলী আশফাক। ৩-১ গোলে হারের সে ম্যাচে আশফাকের অসাধারণ বল প্লে এলোমেলো করে দিয়েছিল বাংলাদেশের রক্ষণকে। একটি গোল করেছিলেন, আরেকটিতে করেছিলেন সহায়তা। তাঁর গতির সঙ্গে সেদিন পেরে ওঠেননি বাংলাদেশের কোনো রক্ষণসেনাই। আশফাককে কেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্লে মেকার বলা হয়, সেদিন বাংলাদেশ খুব ভালোই বুঝেছিল।

এবার মালেতে গোলবন্যা

সে ম্যাচ যেন ছিল এক বৃত্তপূরণ। মালদ্বীপের জন্যই। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রথম দেখায় ৫-০ গোলে হেরেছিল তারা। দ্বিতীয় দেখায় ঢাকায় উড়ে গিয়েছিল ৮-০ গোলে। ২০১৬ সালে মালেতে নিজভূমে বাংলাদেশকে পেয়ে সেই দুই হারের লজ্জাটাই ফিরিয়ে দিয়েছিল তারা। এখন পর্যন্ত মালদ্বীপের সঙ্গে শেষ ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরেছিল ৫-০ গোলের লজ্জাজনক ব্যবধানে। আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ ছিল সেটি। বেলজিয়ান কোচ টম সেইন্টফিটের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ম্যাচও। কিন্তু সেইন্টফিটের পছন্দের একাদশ সেদিন মালদ্বীপের সঙ্গে পাত্তাই পায়নি। ফুটবলে মালদ্বীপ বাংলাদেশকে কতটা পেছনে ফেলেছে, পাঁচ বছর আগে মালের সেই রাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তা।