পাসের পর পাস। খেলোয়াড়দের পারস্পরিক রসায়ন, বোঝাপড়া ও মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা; কোন সতীর্থ মাঠের কোন জায়গায় কখন আছেন, সেটি আগে থেকে বোঝার দক্ষতা—যুগের পর যুগ ধরে বার্সেলোনা এভাবেই খেলেছে, খেলার চেষ্টা করেছে।

ইয়োহান ক্রুইফ দলটাকে যে দর্শন শিখিয়ে গেছেন, বার্সেলোনার বর্তমান কোচ রোনাল্ড কোমান ছিলেন সে দলেরই অংশ। বছরের পর বছর পেপ গার্দিওলা, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, টিটো ভিয়ানোভা, লুইস এনরিকেরা সেভাবেই খেলানোর চেষ্টা করেছেন দলকে। আর খেলার এ ধরন বার্সেলোনাকে এনে দিয়েছে একের পর এক সাফল্য। মেসি-পরবর্তী যুগে বার্সেলোনার স্বপ্নসারথি হয়ে ওঠার কথা কোমানেরই। কিন্তু কোমান তা হতে পারছেন কি?

হতাশ করছেন কোমান
ছবি: রয়টার্স

ক্রুইফের ‘ড্রিম টিমে’ ছিলেন বলেই সরাসরি ডাচ কিংবদন্তির শিষ্যত্ব গ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল কোমানের। তাঁর গোলেই বার্সেলোনা নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ জেতে। সতীর্থ হিসেবে পেপ গার্দিওলার সঙ্গে খেলেছেন বহু বছর। সে হিসেবে কোমানের তো আরও বেশি ক্রুইফের দেখানো পথ ধরে চলার কথা। কিন্তু কোমানের অধীন দলটাকে দেখলে কে বলবে যে তারাই ‘বার্সেলোনা’!

দলটার খেলা দেখলে তাদের সঙ্গে মিল খোঁজা যেতে পারে সত্তর-আশির দশকের প্রথাগত সেই ইংলিশ ক্লাবগুলোর, যারা কেবল আক্রমণের একটি কায়দাই জানত—কোনোরকমে উইঙ্গারের পায়ে বল পৌঁছে দাও, সেই উইঙ্গার সাইডলাইন ঘেঁষে কিছুদূর দৌড়ে অনুসন্ধানী ক্রস পাঠাবে ডিবক্সে থাকা কোনো স্ট্রাইকারের দিকে। হেড করে বল জালে ঢোকানোর চেষ্টা করা ছাড়া যার কাজ শারীরিক শক্তি দিয়ে মার্কারকে ছিটকে দেওয়া। এখনো নিচু সারির অনেক ইংলিশ ক্লাবকে এই গৎবাঁধা আক্রমণ করতে দেখা যায়। কিন্তু তাই বলে বার্সেলোনা!

মেসিহীন দলটা যেন দিশাহীন এক নৌকা
ছবি: রয়টার্স

বার্সেলোনার সমর্থকেরা এত দিন এ ধরনের ফুটবল নিয়ে নাকই সিটকিয়েছে। আসলে যে ক্লাবের একাডেমি মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেতসদের মতো সৃষ্টিশীল খেলোয়াড় তৈরি করেছে, যে ক্লাবে প্রতিভার ছড়াছড়ি, তাদের সমর্থকেরা কেন শরীরনির্ভর, ক্রস ও হেডনির্ভর ফুটবল পছন্দ করবে? কিন্তু কোমানের কল্যাণে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। তাদের প্রিয় দলও যে সে ধরনের খেলাই শুরু করেছে!

২০১৪ সালে ফুলহ্যামের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক ম্যাচ খেলেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ফুলহ্যামকে হারানোর জন্য ইউনাইটেডের সে সময়ের কোচ ডেভিড ময়েস এমন এক কৌশলেরই আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষের বক্সে গুনে গুনে ৮১টি ক্রস পাঠিয়েছিল ইউনাইটেড। লাভ হয়নি, শেষমেশ ২-২ ড্র করতে হয়েছিল তাদের। দুদিন আগে গ্রানাদার বিপক্ষে নিজেদের মাঠে বার্সেলোনার খেলা দেখে ওই ইউনাইটেডের কথাই মনে পড়ে গিয়েছিল যেন। উরুগুইয়ান ডিফেন্ডার রোনালদ আরাউহোর শেষ মুহূর্তের গোলে কোনোরকমে ড্র নিয়ে ফিরেছে বার্সেলোনা।

সে ম্যাচে গ্রানাদার রক্ষণ ভাঙতে গুনে গুনে ৫৪টি ক্রস পাঠিয়েছে বার্সেলোনা। শেষ কবে বার্সেলোনা এক ম্যাচে এক ক্রস করেছিল, সেটি এক গবেষণার বিষয়ই হতে পারে। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা গেল, ২০১৬ সালে লুইস এনরিকের অধীন মালাগার বিপক্ষে ৫৫টি ক্রস খেলেছিল বার্সেলোনা। তবে এনরিকের বার্সা সেদিন যে প্রতিপক্ষের বিশেষ কৌশলের জবাবে এমন করেছিল, সেটি বলাই বাহুল্য। এনরিকের বার্সেলোনা আর যা-ই হোক, ক্রসনির্ভর ছিল না মোটেও। কিন্তু মেসি যাওয়ার পর কোমানের কৌশল দেখে অমনটা বলার অবকাশ নেই। এ বার্সা না পারে প্রতিপক্ষের প্রেস ভাঙতে, না পারে নিজেরা কার্যকর উপায়ে প্রেস করতে, না পারে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখে মাঠে খেলতে।

এ বার্সা দিয়ে যে ‘ঐতিহ্য রক্ষা’ করা সম্ভব নয়, সেটি বোঝা গেছে কোমানের কথা শুনেও, ‘আমাদের খেলোয়াড় তালিকাটা একবার দয়া করে দেখুন। আমরা কী করব! এ দলকে নিয়ে “টিকি-টাকা” ফুটবল খেলব? মাঠে যখন প্রতিপক্ষ আপনাকে জায়গা দিচ্ছে না, আপনি গতি দিয়ে জায়গা বের করতে পারছেন না, তখন “টিকি-টাকা”খেলব কীভাবে!’

লুক ডি ইয়ংকে দলে আনার ব্যাপারটা অনেক বার্সা সমর্থকই মানতে পারছেন না
ছবি: রয়টার্স

ক্রসনির্ভর খেলে এ যুগে সফলতা পাওয়া একটু কঠিনই, এভাবে খেলে সাফল্য পেতে হলে উপযুক্ত খেলোয়াড় দল থাকতে হয়। বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়ই তো সেভাবে ক্রসনির্ভর খেলাতে অভ্যস্ত নন। গ্রানাদার বিপক্ষে ম্যাচেই যেমন মেম্ফিস ডিপাইকে মূল স্ট্রাইকার হিসেবে মাঝে রেখে দুই পাশে খেলানো হলো ফিলিপ কুতিনিও ও ইউসুফ দেমিরকে। ডিপাইকে কোনোভাবেই প্রথাগত স্ট্রাইকার বলা যায় না। ওদিকে কুতিনিও আর দেমিরও প্রথাগত উইঙ্গার নন। তাঁরা ক্রসেও খুব একটা অভ্যস্ত নন। কুতিনিও-দেমির প্রায়ই মাঝে চলে আসছিলেন খেলা গড়ে দেওয়ার জন্য, ওদিকে ম্যাচ যত এগোচ্ছিল, ডিপাই ডিবক্সে না থেকে বাঁদিকে সরে যাচ্ছিলেন। ক্রসনির্ভর খেলায় ডিবক্সে পাঠানোর মতো শারীরিকভাবে শক্তিশালী কোনো স্ট্রাইকারই যদি না থাকে, তাহলে তো সফল হওয়া কঠিনই।

পরে কোমান সে সমস্যার সমাধান করেন লুক ডি ইয়ংকে মাঠে নামিয়ে। কোমানের মতে, এই ডি ইয়ং নাকি ক্রসে নেইমারের চেয়েও ভালো। কিন্তু এই ডি ইয়ং মাত্র কয়েক বছর আগেই নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মতো মাঝারি মানের ইংলিশ ক্লাবেও ঠাঁই পাচ্ছিলেন না। তাই কোমানের এ কৌশলে ডি ইয়ং কতটা কার্যকর হবেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। ডি ইয়ংও সে ম্যাচে ৭৯ মিনিটে সহজতম এক গোলের সুযোগ নষ্ট করে প্রশ্ন তোলার সার্থকতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁর প্রতি কোমানের আস্থা যাতটা, তাঁর নিজের সামর্থ্য ততটা নয়।

দেস্তের খেলাও সেভাবে আশা জাগায় না
ছবি: রয়টার্স

ক্রসনির্ভর ফুটবলে দরকার একজন উইঙ্গার বা উইংব্যাক, যাঁরা দুই উইংয়ে রাজত্ব করবেন গোটা ম্যাচ, নিখুঁত সব ক্রস ফেলবেন প্রতিপক্ষের বক্সে। বার্সার এ দলে ডান দিকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাইটব্যাক সের্হিনিও দেস্ত কিংবা স্প্যানিশ রাইটব্যাক সের্হি রবের্তোকে। দেস্ত যথেষ্ট গতিশীল, তবে ক্রসের ব্যাপারে তাঁর ক্রসটা তেমন যুৎসই নয়। গ্রানাদার বিপক্ষে ১৬টি ক্রস দিয়েছেন দেস্ত, সফল হয়েছেন মাত্র একবার। বাকি ১৫টি ক্রস তিনি সতীর্থের কাছে পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ওদিকে মধ্যমাঠের খেলোয়াড় রবের্তোকে কিছুটা জোর করেই রাইটব্যাকে খেলানো হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। তাঁর খেলাতেও ফুটে ওঠে মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের গুণাবলি। সাইডলাইনে প্রতিপক্ষ থেকে বল কেড়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্রস করার চেয়ে তাঁর মধ্যে মধ্যমাঠে এসে খেলার প্রবণতা অনেক বেশি।

এ বার্সা দিয়ে যে ‘ঐতিহ্য রক্ষা’ করা সম্ভব নয়, সেটি বোঝা গেছে কোমানের কথা শুনেও
ছবি: রয়টার্স

চোটের কারণে মার্টিন ব্রাথওয়াইট, আনসু ফাতি, ওসমান দেম্বেলে মাঠের বাইরে। সুস্থ হলেও বক্সে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের সঙ্গে লড়াই করে বাতাসে ভাসা বলের দখল নেওয়ায় তাঁরা পারদর্শীতা দেখাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ফলে জেরার্দ পিকে, রোনালদ আরাউহো—সবাইকে আক্রমণের সময়ে স্ট্রাইকার হিসেবেই যেন খেলতে বলেছিলেন কোমান, বিশেষ করে পিকে কে। শেষ দিকে ডি ইয়ংয়ের সঙ্গে পিকেই ছিলেন বার্সেলোনার মূল স্ট্রাইকার!

এখন ফাতি, দেম্বেলেরা সুস্থ হওয়ার পরও কোমান যদি তাঁদের নিয়ে ক্রসনির্ভর ফুটবল খেলাতে চান, সে ক্ষেত্রে বার্সেলোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে সেভাবে আশাবাদী হওয়া যায় কি না, সেটি নিয়ে সমর্থকদের যথেষ্ট সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।