ওল্ড ট্রাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে পাঁচ গোলের মালা পরাল লিভারপুল
অবিশ্বাস্য! অকল্পনীয়! অনবদ্য!
ঠিক কীভাবে এই জয়কে বিশেষায়িত করবেন আপনি? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে তাঁদের মাঠে জয় পাওয়াই যেখানে মহার্ঘ্য বিষয়, সেখানে পাঁচ-পাঁচটি গোলের মালা পরিয়ে জয়? খোদ ইয়ুর্গেন ক্লপই কী ভেবেছিলেন এটা? নিশ্চিত ভাবেননি। কস্মিনকালেও ইউনাইটেডের মাঠে এত বেশি গোলে জিতে আসতে পারেনি যে লিভারপুল!
কিন্তু আজ এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটাই ঘটেছে। মোহাম্মদ সালাহর আলোয় ম্লান হয়েছেন রোনালদো, নাবি কেইতার শিল্পিত ছোঁয়ায় নুয়ে পড়েছে ব্রুনো ফার্নান্দেসের যত দাপট। দিওগো জোতার গতির কাছে হার মেনেছেন হ্যারি ম্যাগুয়াররা। ওদিকে ভার্জিল ফন ডাইকরা থামিয়ে দিয়েছেন রাশফোর্ড-গ্রিনউডদের যত হইচই। ওল্ড ট্রাফোর্ডে ৫-০ গোলে জিতেছে লিভারপুল।
হ্যাটট্রিক করেছেন মোহাম্মদ সালাহ, বাকি গোলগুলো করেছেন দিওগো জোতা ও নাবি কেইতা।
নিজেদের চিরপরিচিত প্রেসিংয়ের সঙ্গে ওয়ান-টাচ ফুটবলের মিশেল, লিভারপুল আজ প্রথম থেকেই অপ্রতিরোধ্য ছিল যেন। একাদশ নিয়ে প্রথমে লিভারপুল সমর্থকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও ম্যাচ শুরু হওয়ার পর কোচের সিদ্ধান্তই আস্তে আস্তে সফলতার মুখ দেখে। ফাবিনিওর মতো বিশেষজ্ঞ কোনো রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ছাড়াই মাঠে নেমেছিল লিভারপুল। তাঁর জায়গায় আক্রমণনির্ভর মিডফিল্ডার নাবি কেইতাকে সুযোগ দিয়েছিলেন ক্লপ। ইউনাইটেডের মাঠে কেইতার মতো চোটপ্রবণ খেলোয়াড় কেমন করতে পারেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেকের।
ছিলেন না এই মৌসুমে তর্কযোগ্যভাবে লিভারপুলের সেরা ডিফেন্ডার জল মাতিপও। আক্রমণভাগে ফর্মে থাকা সাদিও মানেকেও বসিয়ে রাখা হয়েছিল। সালাহ আর জোতার সঙ্গে নেমেছিলেন ফিরমিনো।
ওদিকে রাফায়েল ভারানের চোটের কারণে অধিনায়ক হ্যারি ম্যাগুয়ারের সঙ্গে ইউনাইটেড রক্ষণভাগে জুটি বাঁধার সুযোগ পান ভিক্টর লিন্ডেলফ। পল পগবা কিংবা এই মৌসুমে নতুন আসা দামি রাইট উইঙ্গার জেডন সানচো, কাওকেই একাদশে রাখেননি কোচ ওলে গুনার সুলশার। ৪-২-৩-১ ছকে সামনে রোনালদোকে রেখে দুই উইংয়ে রাশফোর্ড-গ্রিনউড ; পেছনে ব্রুনো ফার্নান্দেসকে রেখে একাদশ সাজিয়েছিলেন সুলশার।
তিন মিনিটে প্রথম সুযোগটা কিন্তু ইউনাইটেডই পেয়েছিল। ব্রুনো ফার্নান্দেসের এক শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ইউনাইটেড-ভক্তরা তখন কী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিলেন কী অপেক্ষা করছে তাঁদের সামনে?
এর ঠিক দুই মিনিট পরেই নাবি কেইতা দেখালেন, কেন তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন ক্লপ। দুর্দান্ত এক আক্রমণে সালাহর কাছ থেকে বল নিয়ে ইউনাইটেডের গোলকিপার ডেভিড ডা হেয়াকে সহজেই পরাস্ত করেন এই গিনিয়ান মিডফিল্ডার। লুক শ যতক্ষণে কেইতাকে ট্যাকল করার জন্য পৌঁছেছেন, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছিল।
এক মিনিট পরেই আবারও লিভারপুলের তোপ। এবার কেইতার পাসে গোল করার সুযোগ পেয়েছিলেন ফিরমিনো, কিন্তু ডা হেয়া সেটা হতে দেননি। কিন্তু দুরন্ত লিভারপুলকে আর কতক্ষণই বা আটকে রাখতে পারতেন ডা হেয়া?
১২ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে নাবি কেইতার কাছ থেকে বল নিয়ে ডানপ্রান্ত থেকে বক্সের উদ্দেশ্যে মাটিঘেঁষা এক ক্রস পাঠান লিভারপুলের রাইটব্যাক ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ড। পা ছোঁয়ানো ছাড়া তেমন কিছুই করতে হয়নি লিভারপুলের পর্তুগিজ উইঙ্গার দিওগো জোতাকে।
এর পরেই শুরু হয় সালাহ-শো। এমনিতেই এই মৌসুমে যেমন খেলছেন, মেসি-রোনালদোকে ভুলে অনেকে তাঁকেই বর্তমানে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বলছেন। কেন বলছেন? প্রতিপক্ষের মাঠে সেটা আরেকবার প্রমাণ করার বড্ড সাধ হলো সালাহর। ৩৮ মিনিটে ডানপ্রান্ত থেকে সেই কেইতার কাছ থেকেই বল নিয়ে দুর্দান্ত প্লেসিংয়ে স্কোরলাইন ৩-০ করে ফেললেন সালাহ।
প্রথমার্ধের একদম শেষ মুহূর্তে জোতার কাছ থেকে বল নিয়ে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ফেলেন সালাহ। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগেই ৪-০ গোলে পিছিয়ে থরথর করে কাঁপছে ইউনাইটেড!
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আবারও সালাহ-ঝলক। মাঝমাঠ থেকে লিভারপুলের অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসনের মাপা পাস খুঁজে নেয় প্রতি আক্রমণের অপেক্ষায় থাকা সালাহকে। ৪৯ মিনিটে স্কোরলাইন ৫-০ করে ফেলেন সালাহ। ইউনাইটেডের মাঠে লিভারপুল ঠিক কতটা গোল করে থামবে, সবার আলোচনার বিষয় তখন সেটা।
তাই বলে ইউনাইটেডও যে চুপচাপ বসেছিল, তা নয়। রোনালদোর কল্যাণে একটা গোল প্রায় শোধও দিয়ে ফেলেছিল তাঁরা। কিন্তু ভিএআরের বদৌলতে দেখা যায় রোনালদো অফসাইডে ছিলেন। ফলাফল? গোল বাতিল।
গোলের পর গোল খাওয়ার হতাশা থেকেই কি না, ৬১ মিনিটে কেইতার পা থেকে বল নেওয়ার জন্য বাজে একটা ট্যাকল করে বসেন দ্বিতীয়ার্ধেই গ্রিনউডের জায়গায় মাঠে নামা পল পগবা। প্রথমে তাঁকে হলুদ কার্ড দেখানো হলেও পরে ভিএআরের সহায়তায় রেফারি লাল কার্ড দেখান পগবাকে। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দলকে দশজনের বানিয়ে সাজঘরের পথে পাড়ি জমান পগবা।
শেষদিকে ব্রুনো ফার্নান্দেসের জায়গায় মাঠে নামা উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার এদিনসন কাভানি একটা সুযোগ পেলেও সেটা লাগে গোলপোস্টে, ফলে ব্যবধান কমাতে পারেনি ইউনাইটেড। ওদিকে রোনালদোও বাকি ম্যাচে ফন ডাইক-কোনাতেদের ফাঁকি দিয়ে গোল করতে পারেননি। উলটো লিভারপুলের মিডফিল্ডার কার্টিস জোনসকে লাথি মেরে বেশ দুর্নাম কুড়িয়েছেন, যে কাজের জন্য তাঁকে লাল কার্ড দেখালেও আপত্তি করার তেমন লোক খুঁজে পাওয়া যেত না হয়তো।
অবশ্য লিভারপুল দ্বিতীয়ার্ধে যেমন খেলেছে, মনে হতেই পারে যে ইউনাইটেডকে পাঁচ গোলের বেশি দিতে চাননি সালাহ-মানেরা। এই নিয়ে ঘরের বাইরে নিজেদের শেষ আট ম্যাচে ৩৩ গোল করল লিভারপুল। প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের খেলোয়াড় হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠে গিয়ে হ্যাটট্রিক করে আসার কৃতিত্ব এর আগে কারওর ছিল না, সালাহর কল্যাণে এখন সে ইতিহাসটাও দেখা হয়ে গেল দর্শকদের! ম্যাচসেরা হয়েছেনও এই সালাহই।
বড় সাধ করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন দেখতে এসেছিলেন আজকের ম্যাচ। দেখতে এসেছিলেন নিজের প্রিয় শিষ্য রোনালদো কেমন খেলেন। গুরুকে মুগ্ধ করতে রোনালদো পারলেন কোথায়!