খেলারই কথা ছিল না, তিনিই হয়ে গেলেন নায়ক!

২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেই খেলার কথা ছিল না আমিনুলের। ছবি: আমিনুল হকের ফেসবুক পেজ থেকে
২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেই খেলার কথা ছিল না আমিনুলের। ছবি: আমিনুল হকের ফেসবুক পেজ থেকে

এক যুগ আগে বাংলাদেশ সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছিল টাইব্রেকারে মালদ্বীপকে হারিয়ে। টান টান উত্তেজনার সেই ফাইনালে পেনাল্টি শুট আউটে একটা শট আটকে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আনন্দে ভাসার উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন গোলরক্ষক আমিনুল হক। অথচ জানেন? সে ম্যাচে আমিনুলের খেলারই কথা ছিল না!
সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই আমিনুল হাসতে হাসতে বললেন, ‘ম্যাচের দিন সকালে বাঁ পাঁজরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলাম। সময় যত গড়াচ্ছিল, ব্যথা ততই বাড়ছিল। ম্যাচের ঘণ্টাখানেক আগে ব্যথা এমনই বেড়ে গেল, দ্বিতীয় গোলরক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্যকে প্রস্তুতি নিতে বলে দিয়েছিলেন কোচ কোটান। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। এমন একটা প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশ, আর আমি খেলব না! দলের চিকিৎসককে বলে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিলাম। আল্লাহর রহমতে সেই ইনজেকশনে ম্যাচের সময় ব্যথা টের পাইনি। পেনাল্টিও ঠেকিয়ে দিলাম।’
২০০৩ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশের ফুটবলের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ঘরের মাঠে কী এক অপরূপ প্রতিজ্ঞা নিয়ে জ্বলে উঠেছিল গোটা দেশ। গোলপোস্টের নিচে আমিনুল হক ছিলেন পুরো প্রতিযোগিতাতেই অনন্য! গ্রুপ পর্যায়ের তিনটি ম্যাচে নেপাল, মালদ্বীপ আর ভুটানের বিপক্ষে জালে বল ঢুকতে দেননি। সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষেও ৮১ মিনিট আগলে রেখেছিলেন গোলদূর্গ। টানা ৩৫১ মিনিট গোল না-খেয়ে আমিনুল যেন বার্তা দিচ্ছিলেন, আমি শেষ প্রাচীর হয়ে আছি। ভয় নেই।
ফাইনালের দিন সকালে সে সময়কার শেরাটন হোটেলের টেনিস কোর্টে ব্যথাটা পেয়েছিলেন আমিনুল। টেনিস কোর্টে পায়ে বল নিয়ে কারিকুরি করছিলেন। এ সময় সতীর্থ ডিফেন্ডার নজরুল ইসলামের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পড়ে গিয়ে বাঁ পাঁজরে প্রচণ্ড ব্যথা পান। আমিনুল জানালেন, ‘ব্যথাটা পেয়েছিলাম নিজেদের ভুলেই। আমাদের কিন্তু কেউ পাকা টেনিস কোর্টে বল নিয়ে অমন কসরত করতে বলেনি। ব্যথা পাওয়ার পর পুরো টিম ম্যানেজমেন্ট হোটেলের নিচে নেমে এসে আমাদের সে কী বকাঝকা! তার চেয়েও বড় কষ্ট পাচ্ছিলাম ফাইনাল মিস করব এই ভেবে।’
গোটা দেশ যখন ফাইনালের ভাবনায় ব্যাকুল, তখন সবার অগোচরে হোটেল শেরাটনের টেনিস কোর্টে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন আমিনুল, ‘খেলাটা খেলতে না-পারার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল। খেলতে না পারলে নিজেকে কখনো ক্ষমাও করতে পারতাম না।’
আমিনুল সেবার বাংলাদেশের স্কোয়াডে এক নম্বর গোলরক্ষক হলেও দ্বিতীয় গোলরক্ষক হিসেবে ছিলেন দেশের আরেক সেরা গোলরক্ষক বিপ্লব। আমিনুলের অবস্থা দেখে কোচ জর্জ কোটান বিপ্লবকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। সে ম্যাচের কিছুক্ষণ আগেও ঠিক ছিল ম্যাচটা খেলবেন বিপ্লবই। আমিনুল জানালেন, ‘বিপ্লব তো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। সবচেয়ে বড় কথা, বিপ্লবের অসাধারণ কিপিংয়েই আমরা ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসে ফুটবলের সোনা জিতেছিলাম। তাই আমি না খেললেও বিপ্লব মনে হয় ঠিকই সামলে নিত। কিন্তু খেলতে না পারলে সারা জীবনই আমার আফসোসটা থেকে যেত।’
আমিনুল শেষ পর্যন্ত কড়া ডোজের ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়েও ম্যাচটা দারুণ খেলেছিলেন। রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের গোলে খেলায় বাংলাদেশ প্রথমে এগিয়ে গেলেও মালদ্বীপ ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে এনেছিল। অতিরিক্ত সময়ের একটা পর্যায়ে মতিউর মুন্নার দূরপাল্লার শট মালদ্বীপের গোলরক্ষককে পরাভূত করলেও বারে লেগে ফেরত এসেছিল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কানায় কানায় ভরা গ্যালারিও হতাশায়। গোলটা হলে আর টাইব্রেকারের লটারিতে যেতে হয় না। টাইব্রেকার ভাগ্যও যে সহায় হয় না বাংলাদেশের!
আমিনুল সেই শঙ্কা দূর করেছিলেন টাইব্রেকারের একটি শট ঠেকিয়ে দিয়ে। শেষ শটটা মোহাম্মদ সুজন মালদ্বীপের গোলরক্ষকের পাশ ঘেঁষে জালে ঠেলে দিতেই বাঁধভাঙা উল্লাস গোটা স্টেডিয়ামে। ওটা যে ছিল বাংলাদেশের ফুটবলেরই অবিস্মরণীয় এক মুহূর্ত।