খেলার বুট, জার্সি পুড়িয়ে ফেলেছি

কাবুলে অবস্থান করা এই ফুটবলার কথা বলেছেন সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁর ছবি ও নাম প্রকাশ করা হলো না।

ছবিটি প্রতীকী। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা নাম ও ছবি না প্রকাশ করার শর্তেই কথা বলেছেন এক আফগান নারী ফুটবলারছবি: রয়টার্স

‘আমাদের মেয়েদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা কথাটার কেমন যেন অনিশ্চয়তা, অশান্তি। তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের অপমৃত্যুর শঙ্কা। কাবুলেই জন্ম, কাবুলে বেড়ে ওঠা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সেখানে বসেই মুঠোফোনে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। আফগানিস্তানে ফিরে এসেছে তালেবানি নিয়ন্ত্রণ। একজন নারী খেলোয়াড় হয়ে পরিচয় প্রকাশ করে তালেবানদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, সে সাহস দেশটিতে কারই–বা আছে!

একসময় এই ফুটবলারই বিদেশের মাটিতে আফগানিস্তানের জাতীয় সংগীত গেয়ে দেশকে জেতানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফুটবল মাঠে নামতেন। অথচ এখন কিনা জীবন বাঁচাতে তিনিই ভুলে যেতে চান নিজের ফুটবলার সত্তা! আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছেন খেলার বুট, প্রিয় জার্সি। কেমন আছেন—ঢাকা থেকে করা প্রশ্নটি তাঁর কাছে হয়তো রসিকতার মতোই শোনাল। উত্তরে বললেন, ‘আমরা সবাই খুব বিপদের মধ্যে আছি, বিশেষ করে মেয়েরা। আমাদের জীবন হুমকির মধ্যে। খুব কঠিন সময় পার করছি। জানি না সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে।’

তালেবান নিয়ন্ত্রণে বিপদের মধ্যে আছেন আফগান নারী ফুটবলাররা
ছবি: রয়টার্স

মেয়ে ফুটবল খেলত—তালেবানরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এ রকম একটা পরিবারের মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, সেটা বোঝাই যায়। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই দিন কাটছে তাদের। সংগত কারণেই তাঁর পরিবার সম্পর্কেও এখানে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হলো না। তবে ওই ফুটবলার জানিয়েছেন, পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে তাঁদের। পুরুষেরা হয়তো প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। মেয়েদের সে সাহস দেখানোরও উপায় নেই।

তবু গত বৃহস্পতিবার আশুরার দিনে ঘর থেকে একটু বের হয়েছিলেন ওই নারী ফুটবলার। বের হয়ে দেখেছেন নতুন এক কাবুল শহর, ‘তালেবানরা রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে। কোথাও কোথাও চেকিং হচ্ছে। রাস্তায় খুব কম মানুষ ছিল। সবার মধ্যে ভয়। পরিচিতরা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলছিলেন “তুমি মেয়ে হয়ে কেন বাইরে এসেছ?” সবকিছু আমার কাছে নতুন লাগছিল। খুব হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরেছি।’

তালেবান নিয়ন্ত্রণে নারীর স্বাধীনতাও নিয়ন্ত্রিত
ছবি: রয়টার্স

কদিন আগেও কাবুল শহরে যে প্রাণ ছিল, এখন সেটাই যেন আতঙ্কের জনপদ! খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বন্ধ। প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য দোকানপাট খোলে। দরকারি কেনাকাটা করে আবার যে যার ঘরে। এর মধ্যে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।

তালেবানদের শাসনে দেশটিতে মেয়েদের জাতীয় দল থাকবে কি না, সেই প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে উঠেছে। নারী দলের ওই ফুটবলার হতাশ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আর হয়তো সম্ভব হবে না। এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে আমাদের অনুশীলন বন্ধ। আমি তো এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আমার সব ছবি সরিয়ে ফেলেছি। খেলার বুট, জার্সি পুড়িয়ে ফেলেছি। আমি যে একজন খেলোয়াড়, তার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্য সবই শেষ হয়ে গেছে।’ আগামী মাসে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বেও হয়তো খেলা হবে না আফগানিস্তানের মেয়েদের।

তালেবান শেষ করে দিয়েছে আফগান নারী ক্রীড়াবিদদের স্বপ্ন
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তান ফুটবলকে এরই মধ্যে শোকের চাদরে ঢেকে দিয়েছে দেশটির অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক খেলোয়াড় জাকি আনওয়ারির মৃত্যু। উড়োজাহাজের চাকার বাক্সে ঢুকে দেশ ছাড়তে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন এই তরুণ ফুটবলার। আনওয়ারির সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও প্রথম আলোকে ওই নারী ফুটবলার বলছিলেন, ‘আমরা ছেলেরা ও মেয়েরা আলাদা অনুশীলন করায় তাঁকে আমি চিনতাম না। তবে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে।’

তালেবান আতঙ্কে প্রতিদিনই আফগানিস্তান ছাড়ছেন সে দেশের মানুষ। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলা এই নারী ফুটবলারও আশায় আছেন—যদি পরিবার নিয়ে চলে যাওয়া যায় দেশ ছেড়ে! সে জন্য তাকিয়ে আছেন ফিফা ও এএফসির দিকে, ‘আমরা আশায় আছি আমাদের ফুটবল ফেডারেশন ফিফা ও এএফসিকে আমাদের বিপদের কথা জানাবে। এই অবস্থায় তারাই শুধু পারে আমাদের উদ্ধার করতে। আমরা পরিবার নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে চাই।’