ছিয়াশির ম্যারাডোনা, নাপোলির ম্যারাডোনা

১৯৮৬ বিশ্বকাপ হাতে ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্তছবি: এএফপি

‘আরে না! মাথা খারাপ নাকি! আমাদের সঙ্গে কোনো অস্ত্রশস্ত্র দেখছেন? নাকি আমাদের ঘাড়ে কোনো রাইফেল ঝুলছে?

শুনুন, আমরা এখানে শুধুই ফুটবল খেলতে এসেছি। আমরা খেলোয়াড় মানুষ, রাজনীতির ময়দানে কী হলো না–হলো ওসব আমরা বুঝিটুঝি কম। আর দুদিন আগেই টটেনহামের মাঠে ওসি'র (ওসভালদো আর্দিলেস, টটেনহামের আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি) সম্মানার্থে আয়োজিত বিদায়ী ম্যাচ খেলে এলাম, ওরা পুরোটা সময়জুড়ে গলা ফাটিয়ে আমার নামে স্লোগান দিল। এত কিছু দেখার পর আমি কীভাবে ইংলিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে পারি, আপনিই বলুন?’

প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। খেলার মাঠে পায়ের চাতুর্যে মুগ্ধ করা ম্যারাডোনা তত দিনে মুখের কথা দিয়েও 'ড্রিবল' করা শিখে গেছেন।

কথার জাদুতে ভুলিয়ে দিলেন ব্রিটিশ মিডিয়াকে। ম্যারাডোনার সুরে সুর মেলালেন হোর্হে ভালদানো, হোর্হে বুরুচাগারাও। ব্রিটিশরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, যাক, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়টির মনে আমাদের নিয়ে অন্তত চাপা ক্ষোভ নেই।

সেটি থাকলেই বিপদ। প্রতিভার আগুনের সঙ্গে ক্ষোভের লেলিহান শিখার যুগলবন্দী যে বড্ড ভয়জাগানিয়া! আর যা-ই হোক, ইংল্যান্ড সে আগুনে পুড়তে চায় না।

ছিয়াশি বিশ্বকাপ জিতে অমরত্বে নাম লেখান ম্যারাডোনা
ছবি: টুইটার

ব্রিটিশরা বোঝেনি, ওসব কথা ম্যারাডোনার 'বডি ফেইন্ট' বা 'স্টেপওভার' এর মতোই ছলনায় ভরপুর। চার বছর আগের ম্যারাডোনা এটা করতেই পারতেন না। কিন্তু চার বছর পরের ম্যারাডোনা আরও বেশি পরিণত। মাঠের ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন।

এ ম্যারাডোনা চার বছর আগের ম্যারাডোনার মতো ফকল্যান্ডের যুদ্ধ হারের দুঃখে আর একের পর এক ফাউলের শিকার হয়ে রেগেমেগে হাল ছেড়ে দিয়ে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লোক নন। এ ম্যারাডোনা দশবার ফাউলের শিকার হয়ে এগারোতমবারেও উঠে দৌড়াতে জানেন। এ ম্যারাডোনার হৃদয়ে ছাইচাপা আগুন।

দেশকে সেরা বানানোর অদম্য প্রত্যয় তাঁর, চোখে–মুখে জ্বলজ্বল করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা।
আগেরবার ব্রাজিলের কাছে হেরে শেষ হয় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ। লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়া ম্যারাডোনা সেবার নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।

সুযোগ পেয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন পেলে, ‘ও টাকার জন্য খেলে। আসলেই গ্রেট হওয়ার ক্ষমতা ওর আছে কি না, সন্দেহ আছে।’

পেলের সুরে সুর মিলিয়ে চার বছর ধরে অনেক মানুষই ম্যারাডোনার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বার্সেলোনার হয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে না পারা ম্যারাডোনা নিজেও নিন্দুকদের গলার আওয়াজ বাড়াতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু ছিয়াশির ম্যারাডোনা সে গুঞ্জন থামাতে সময় নেননি।

প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া তাঁকে থামানোর বহুল পরীক্ষিত 'ফর্মুলা'রই প্রয়োগ ঘটাল। ফাউল করে গেল একের পর এক। কিন্তু এ যে ভিন্ন ম্যারাডোনা! দেশকে কিছু এনে দেওয়ার দৃঢপ্রতিজ্ঞা তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হলো নাপোলিতে খেলার সুবাদে নিয়মিত ইতালির অতি রক্ষণাত্মক ফুটবলটা খেলার সুফল।

প্রতি সপ্তাহেই যে ম্যারাডোনা বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষণাত্মক লিগে বিশ্বসেরা ডিফেন্ডারদের বিপক্ষে মাঠে নামেন, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম না জানা খেলোয়াড়দের গা-জোয়ারি খেলায় তিনি থামবেন কেন? ম্যাচ শেষ করলেন তিনটি গোলে সহায়তা করে।

গতবার যে ইতালির কড়া মার্কিংয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, এবার সেই ইতালিই দেখল ম্যারাডোনার পায়ের জাদু। বুলগেরিয়া আর উরুগুয়ের বিপক্ষেও একই কাহিনি। তত দিনে বিশ্বও যেন জেনে গেছে, ম্যারাডোনা এবার শেষের আগে শেষ বলতে রাজি নন।

এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ, যে ম্যাচের আগে ম্যারাডোনার মনভোলানো কথা শুনে গলে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। এতটাই যে ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীত 'গড সেভ দ্য কুইন' চলার সময় ম্যারাডোনার পাথরের মতো অভিব্যক্তিহীন শক্ত মুখ, জ্বলজ্বল করতে থাকা নিথর চোখ দুটো হয়তো নজরে পড়েনি গ্যারি লিনেকার, পিটার শিলটন, টেরি বুচারদের।

নব্বই মিনিট পর রোদের আলোয় উদ্ভাসিত মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়াম জ্বলে উঠল ম্যারাডোনার দ্যুতিতে। ইংল্যান্ডকে হারানোর জন্য যাঁর সংকল্প ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রথমার্ধে বলতে গেলে তেমন কিছুই হলো না।

পরিচিত সূত্র মেনে নিজেরা খেলার চেয়ে ম্যারাডোনাকে আটকানোর দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন বুচার-ফেনউইকরা। কিন্তু ম্যারাডোনা যে সেই পুরোনো ওয়াইনের মতো, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যা আরও সুস্বাদু হয়ে ওঠে!

দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে নিজের ভেতরের 'ড. জেকিল' আর 'মিস্টার হাইড'কে দেখিয়ে দিলেন ম্যারাডোনা। প্রথম গোলে যদি ছলাকলা দেখিয়ে হলেও যেকোনো মূল্যে তাঁর দলকে জেতানোর ইচ্ছা প্রকাশ পায়, দ্বিতীয় গোলে বিশ্ব দেখেছে কোনো ছলাকলা নয়, নিজের অমিত প্রতিভাবলেই তিনি তখন বিশ্বের অবিসংবাদিত সেরা।

গোটা বিশ্বকাপে হোর্হে ভালদানো চার গোল করলেও তাঁর ফর্ম দেখে তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। ওই ম্যাচেও ম্যারাডোনার পাস আয়ত্তে আনতে গিয়ে চারবারের মতো বলের দখল হারিয়েছিলেন। কে জানত, ভালদানোর আরেকটা বল দখলের ব্যর্থতাই জন্ম দেবে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিতর্কের?

ভলি করতে চেয়েছিলেন কি না, কে জানে, বল দখল করতে গিয়ে মিডফিল্ডার স্টিভ হজ উড়িয়ে মারলেন গোলরক্ষক শিলটনের দিকে। ওখানে যে ম্যারাডোনা থাকতে পারেন, কস্মিনকালেও ভাবেননি তিনি। ঠিক যেমনটা ভাবেননি, হেড করার ছলে ম্যারাডোনা বাঁ হাত দিয়ে বল ঢুকিয়ে দেবেন জালে!

ম্যারাডোনার উদ্যাপনটাও ছিল যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। গ্যালারির যে প্রান্তে বাবা আছেন, সেখানে গিয়ে বাঁ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বাতাসে ঘুষি মারছিলেন বারবার। ওদিকে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা তখন রেফারির কাছে ম্যারাডোনার 'ছলচাতুরী'র নালিশ করতে ব্যস্ত।

এক ভালদানোই বুঝতে পেরেছিলেন, যে হাত দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ গোলটা এসেছে, সে হাতের মুষ্টি বারবার দর্শকদের দিকে দেখানোটা ঠিক হবে না ম্যারাডোনার জন্য। 'কী করছ তুমি? হাত নামাও! হাত নামাও!’, ভালদানোর মনে তখন সম্ভাব্য গোল বাতিলের শঙ্কা।

শঙ্কাটা সত্যি হয়নি যদিও। উল্টো চার মিনিট পর ম্যারাডোনা নিজের সত্তার আরেক দিক দেখিয়ে দিলেন ইংলিশদের। মাঝমাঠ থেকে ছয়জনকে সাতবার কাটিয়ে গোল করার বর্ণনা ৩৪ বছর পর আর না দিলেও হয়তো চলবে, দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ হয়েছে সেটির প্রশংসায়।

সে তুলনায় পরের রাউন্ডে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যারাডোনার দ্বিতীয় গোলটা নিয়েই বরং আলোচনা হয় কম। অথচ ফুটবলশৈলী ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এ গোলটিও কম নয়। বিরাশিতে এই বেলজিয়ামের বিপক্ষেও মার খেয়ে নিশ্চুপ থেকেছিলেন ম্যারাডোনা।

ম্যাচ শেষে এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে বেলজিয়ামের অধিনায়ক এরিক গেরেৎসের সঙ্গে জার্সি বদল করতেও মন সায় দেয়নি তাঁর। ছিয়াশিতেও এই গেরেৎস ছিলেন। ম্যারাডোনা-জাদুতে হতভম্ব গেরেৎস দেখেছিলেন মুদ্রার উল্টো পিঠ।

ফাইনালে লোথার ম্যাথাউসের যন্ত্রণায় হয়তো গোল করা হয়ে ওঠেনি ম্যারাডোনার, তবে বুরুচাগার জয়সূচক গোলে সহায়তা ছিল তাঁর। ম্যারাডোনা জানতেন, দলে তাঁর প্রতিভাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে এক বুরুচাগাই আছেন।

গোটা টুর্নামেন্টে দুজনের যুগলবন্দী মোহিত করেছিল দর্শকদের। বুরুচাগার গোলটা যেন বিশ্বকাপ নামক সার্থক চিত্রকর্ম আঁকা তুলির শেষ আঁচড়। পাঁচ গোল আর পাঁচ অ্যাসিস্টের পাশাপাশি ৫৩টি সফল ড্রিবল। সে টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় সফল ড্রিবলকারীর ড্রিবল সংখ্যা ছিল তাঁর চেয়ে ৩৭টি কম।

ম্যারাডোনাময় এক বিশ্বকাপের শেষে ম্যারাডোনার হাতে ট্রফিটা না থাকলেই যে অবিচার হতো!

নাপোলিতে রাজার সম্মান পেয়ে এসেছেন ম্যারাডোনা
ছবি: এএফপি

নেপলসের ‘ঈশ্বর’:

‘লাভাতেভি! লাভাতেভি!’

চিৎকারে কান পাতা দায়। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করছে তো বটেই, গলার আওয়াজে পায়ের তলার মাটিও থরথর করে কাঁপছে যেন। তাও যদি নিজেদের পক্ষে স্লোগান দিত, নিজেদের নামে জয়ধ্বনি শোনা যেত, সেটিও সহ্য করা যেত।

‘লাভাতেভি’ শব্দের অর্থটা চরম অসম্মানের। ‘পরিষ্কার হয়ে এসো,’ চিৎকার করতে থাকা হেল্লাস ভেরোনা সমর্থকদের ইঙ্গিতটাও পরিষ্কার। নেপলস গরিবদের শহর, নাপোলি গরিবদের ক্লাব, দীনহীনদের আবাস, অপরিচ্ছন্ন-নোংরা খেলোয়াড়েরা খেলেন সেখানে। সুতরাং, ‘পরিষ্কার হয়ে এসো!’

খেলোয়াড়দের টানেলে সতীর্থদের সঙ্গেই ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ফেরারা, বানিয়ি, বার্তোনিরা দাঁড়িয়ে, পাশে থাকা ম্যারাডোনা নিবিষ্টমনে বুট জোড়ার ফিতা বেঁধে নিচ্ছিলেন। সদ্য দলে আসা আর্জেন্টাইন তারকা তত দিনে কাজ চালানোর মতো ইতালিয়ান ভাষা শিখে গেছেন, ভেরোনা-সমর্থকদের টিটকারি না বোঝার কথা নয়।

নাপোলির ম্যারাডোনাকে কখনো ভুলতে পারবেন না নেপলসবাসীরা
ছবি: টুইটার

মাথায় ঘুরছে আরও একটা কথা। কিছুক্ষণ আগে মাঠে যখন ঢুকছিলেন, চোখে পড়েছিল একটা ব্যানার। এতটাই বড় সে ব্যানার, চাইলেও না তাকিয়ে থাকতে পারতেন না ম্যারাডোনারা। স্পষ্ট অক্ষরে তাতে লেখা আছে, ‘ইতালিতে স্বাগতম, নাপোলি!’

সূক্ষ্ম খোঁচা লুকিয়ে আছে এখানেও। তাদের মতে, নাপোলি ইতালির অংশ নয়। দক্ষিণের দারিদ্র্য, অপরাধপ্রবণ, অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলটাকে উত্তরের নাক-উঁচু ভেরোনাবাসীরা যেন স্বদেশি বলে মানতেই চাইছে না।

এ যেন উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের খলচরিত্রের সেই সফল ব্যবসায়ী বাবা, বেকার-ব্যর্থ ছেলেকে মুহূর্তের মধ্যে কুলাঙ্গার বলতেও যাঁর মুখে আটকায় না, ত্যাজ্য করতেও বাধে না।

ম্যারাডোনা তখনই বুঝে গেলেন যা বোঝার। যে ক্লাবে এসেছেন, সে ক্লাব তাঁকে পাওয়ার জন্য টাকা ঢালার বিশ্ব রেকর্ড গড়লেও মাঠ ও মাঠের বাইরে সম্মানের দিক দিয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে।

ম্যারাডোনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নাপোলি অধিনায়ক লরেঞ্জো ইনসিনিয়ে
ছবি: টুইটার

একটা নায়কের জন্য বছরের পর বছর ধরে গুমরে মরছে তারা। যে নায়ক মাঠের ভেতরে ও বাইরে টেনে তুলবেন নাপোলিকে, বসাবেন সমাজের ওপরতলায় থাকা জুভেন্টাস, মিলান, ইন্টারের পাশে। কুলীন বানাবেন।

বুটের ফিতা বেঁধে টানেল থেকে বের হয়ে ১০ নম্বর জার্সি পরা যিনি মাঠের দিকে পা বাড়ালেন সেদিন, তিনি নিখাদ একজন খেলোয়াড় ছিলেন না। ছিলেন এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষ, যিনি ‘নেপোলিটানসের (নেপলসের অধিবাসী)’ নায়ক হতে প্রস্তুত। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা ভেরোনাবাসী সেদিন বুঝল না, সাড়ে পাঁচ ফুটের বেঁটেখাটো মানুষটার মধ্যে কী প্রকাণ্ড অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা!

অবশ্য সমাজের নিচুতলার গরিব মানুষদের প্রতি ম্যারাডোনার টান আজকের নয়। নিজের জন্ম আর বেড়ে ওঠাই তো বস্তিতে, দিনের পর দিন শতচ্ছিন্ন কাপড় আর আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষদের কষ্টটা কেমন, বেশ ভালোই বুঝতেন।

নাপোলির হয়ে বল পায়ে ছুটছেন ম্যারাডোনা
ছবি: টুইটার

ধনকুবেরদের রিভার প্লেট নয়, মনে ঠাঁই দিয়েছিলেন শ্রমজীবীদের বোকা জুনিয়র্সকে। রিভার প্লেট হাজারো চাওয়ার পরও তাদের ফাঁকি দিয়ে যোগ দিয়েছিলেন বোকায়।

ওই যে ভেতরে থাকা স্বভাবজাত ওই নেতা সব সময় চাইতেন তাদের মুখপাত্র হতে, যাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। নাপোলিতেও নিজেকে ঘুরেফিরে ওই একই পরিস্থিতিতে খুঁজে পান ম্যারাডোনা, যে পরিস্থিতিতে বরাবরই নিজেকে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

দলে এসেই সভাপতি কোরাদো ফেরলাইনোকে সাফ জানিয়ে দেন—উন্নতি করতে চাইলে তাঁর কথা শুনতে হবে। কিনতে হবে তাঁর পছন্দের খেলোয়াড়। দলে ম্যারাডোনার প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে কোচ ওটাভিও বিয়াঞ্চি পর্যন্ত তাঁকে সমঝে চলতেন। বিয়াঞ্চি নিজে ছিলেন ইতালির ফুটবলার।

খেলতেনও তখন, যখন ইন্টারের অতিরক্ষণাত্মক ‘কাতেনাচ্চিও’ স্টাইলের জয়জয়কার চারদিকে। ফলে কোচ বিয়াঞ্চির মধ্যেও সে রেশটা থেকে গিয়েছিল, চাইতেন তাঁর ফরোয়ার্ডরাও যেন রক্ষণকাজে সাহায্য করেন।

ম্যারাডোনাকে দিয়ে পাকা ডিফেন্ডারের মতো স্লাইডিং ট্যাকল করাতে চাইলেন। লাভ হলো না। ‘আমাকে প্রতিপক্ষের কেউ ধাক্কা মেরে মাটিতে না ফেলা পর্যন্ত আমি মাটিতে গড়াগড়ি খাব না,’ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন রক্ষণে অনাগ্রহী ম্যারাডোনা।

আক্রমণভাগেই ফোটাতে চাইতেন নিজের পায়ের সব ফুল, করতে চাইতেন প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ।

সব অর্কেস্ট্রা দলে একজন ‘কন্ডাক্টর’ থাকেন, যাঁর ভূমিকাটাই প্রধান। অর্কেস্ট্রার বাকিদের কাজ হয় পুরো পারফরম্যান্সকে শ্রুতিমধুর করে তুলতে তাঁকে সাহায্য করা। ‘কন্ডাক্টর’ ম্যারাডোনা তাঁর নাপোলি নামের ‘অর্কেস্ট্রা’কে সুমধুর করে তোলার জন্য কয়েকজনকে দলে চাইলেন।

লাৎসিওর ফরোয়ার্ড ব্রুনো জিওর্দানো, হেল্লাস ভেরোনার গোলরক্ষক ক্লদিও গারেল্লা, সাম্পদোরিয়ার ডিফেন্ডার আলেসসান্দ্রো রেনিকা—প্রত্যেকেই এলেন ম্যারাডোনার পীড়াপীড়িতে। ফলও এল হাতেনাতে। যে দলটা বছর দুয়েক আগেও এক পয়েন্টের জন্য অবনমন এড়িয়েছিল, সে দলটাই লিগ শেষ করল তৃতীয় হয়ে।

নাপোলির ‘স্পর্ধা’ দেখে ভিত নড়ে গেল কুলীন সম্প্রদায়ের। ম্যারাডোনা নিজেই গর্বভরে নিজের আত্মজীবনী এল দিয়েগোতে লিখেছেন কথাগুলো, ‘জুভেন্টাসে প্লাতিনি ছিল, মিলানে খুলিত, ইন্টারে রুমেনিগে, ফিওরেন্টিনায় তরুণ ব্যাজিও আর রোমায় কন্তি—সবার দলই ছিল তারায় ভরা।

তাও ওরা আমাদের ভয় পেত।’ সতীর্থদের যে তত দিনে মাথা না নুইয়ে বেঁচে থাকার মজাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যারাডোনা! একঝাঁক অকুতোভয় এবার সোজা লিগটাই জিতে নিলেন।

ইতিহাসের প্রথম লিগ জেতার উৎসবটাও হলো দেখার মতো। নাপোলি এমনিতেও ফুটবলপাগল এক শহর। গোটা শহরের মানুষ যেন নেমে এল রাস্তায়। রং, কনফেত্তি, বাঁশি, পতাকা, মদ, খাবারদাবার—কী ছিল না সেই উৎসবে!

কথিত আছে, নাপোলির রাস্তায় লম্বা লম্বা খাবার টেবিল বসানো হয় সেবার। পকেটে টাকা নেই, তাতে কি? যার যা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে, শুধু টেবিলে বসে পড়লেই হয়েছে। পিৎজা, পাস্তা, রিসোত্তো, পেসকে, ওয়াইন চলে আসছে নিমেষে।

সবাইকে নিয়ে এভাবেই সপ্তাহখানেক ধরে উদ্যাপন করেছিল নাপোলিবাসী। ম্যারাডোনার নামে গির্জা হলো, প্রতিটা দোকানে মাতা মেরি আর যিশুর ছবির মাঝখানে ম্যারাডোনার পোর্ট্রেট শোভা পেল।

মূর্তি, গ্রাফিতি, ম্যুরাল—উদ্যাপনের সেই রেশ এখনো দেখা যায় নাপোলিতে গেলে। নাপোলিবাসীর কাছে আক্ষরিক অর্থেই ঈশ্বর হয়ে গেলেন ম্যারাডোনা। যে ঈশ্বর তাদের উদ্ধার করেছেন, নিয়ে গেছেন প্রতিশ্রুত সেই স্বর্গরাজ্যে।

নাপোলিকে পরেও লিগ জিতিয়েছেন ম্যারাডোনা। জিতিয়েছেন উয়েফা কাপ, ইতালিয়ান কাপ ও কোপা ইতালিয়ার মতো শিরোপাগুলোও। তবে তত দিনে সভাপতির সঙ্গে রেষারেষিটা তুঙ্গে ঠেকেছে।

মাফিয়াদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার গুঞ্জন, বাড়তে থাকা কোকেন-আসক্তি, ডোপপাপের নিষেধাজ্ঞা, কর ফাঁকির খবর, একের পর এক অনৈতিক সম্পর্ক আর নব্বইয়ের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে ইতালির হার—কোনোটাই ম্যারাডোনাকে সাহায্য করেনি আর কটা দিন নাপোলিতে থাকার জন্য।

তবে একটা জিনিসে সাহায্য করেছে ঠিকই। ম্যারাডোনার এসব কাণ্ডকীর্তি তাঁকে নাপোলিবাসীর আরও আপন করেছে। তারা ভেবেছে, ‘আরে, আমাদের ঈশ্বর তো আমাদের মতোই!’

বাকি ইতালির চোখের বিষ হয়ে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। রাজার হালে নেপলসে পা দেওয়া ম্যারাডোনার বিদায়টা তাই পেছনের দরজা দিয়ে হলেও নেপোলিটানদের তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে।

শোনা যায়, আশির দশকের শেষ দিকে নেপলসে যত ছেলের জন্ম হয়েছে, শতকরা আশি শতাংশের নামের প্রথম অংশই দিয়েগো রাখা হয়েছিল।

নাপোলিকে সাধারণ ক্লাব থেকে বিশ্বমানের ক্লাবে তুলে এনেছিলেন ম্যারাডোনা। ছবিটি সাদা কালো হলেও ভক্তদের মনে চিরসবুজ
ছবি: টুইটার

ইতালির জাতীয় নির্বাচনে অন্তত ২০ হাজার মানুষ কাউকে ভোট না দিয়ে ব্যালট পেপারে ‘ম্যারাডোনার জয় হোক’ লিখে দিয়ে এসেছিলেন। নব্বইয়ের বিশ্বকাপে নাপোলির অনেকেই নিজের দেশ বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন।

নায়ক চাইতে গিয়ে নেপলস পেয়ে গিয়েছিল তাদের ‘ঈশ্বর’। বাকি দুনিয়ার কে কী ভাবল, তাতে তাদের থোড়াই কেয়ার!

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বহুদিন পর নিজের দ্বিতীয় ঘরে ফিরেছিলেন ম্যারাডোনা। এক বিকেলে রয়্যাল কন্তিনেন্তাল হোটেলের ব্যালকনি থেকে নিচে থাকা জনসমুদ্রের দিকে আস্তে আস্তে হাত নাড়িয়েছিলেন হাসিমুখে।

মানুষের ভালোবাসায় হয়েছিলেন সিক্ত। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসেছিলেন নিজেদের ‘আইকন’কে একনজর দেখার জন্য। কিংবদন্তিকে দেখতে অনেকে নিজের পকেটের সর্বশেষ মুদ্রাটিও খরচ করে ফেলেছিলেন। উদ্দীপনা দেখে মনে হতে পারে, শহরে পোপ এসেছেন বুঝি।

না, সেদিন পোপ আসেননি। এসেছিলেন নেপলসের ‘ঈশ্বর’, যে ঈশ্বর একদিন নাপোলির মাঠে দেখিয়েছিলেন জাদু, জাদুবলে নেপোলিটানদের বিশ্বাস করাতে শিখিয়েছিলেন, ‘আমরাও পারি।’