জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তানভীর

তানভীর চৌধুরী
তানভীর চৌধুরী

সাত মাসের ছোট্ট তানবিতা কখনো মায়ের কোলে, কখনো নানা-নানির কোলে। পাঁচ বছরের তাবিতা চুপচাপ। দুই শিশুকন্যা জানে না কী ঝড়ই না বইছে গোটা পরিবারের ওপর। ওরা জানে না বাবা তানভীর চৌধুরী জীবন্মৃত। শরীরের কোনো সাড়া নেই। গত মঙ্গলবার থেকে তাঁর নিথর দেহ রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউর বিছানায়।
কাল বিকেলে সেই আইসিইউতে গিয়ে কান্না চেপে রাখাই কষ্ট হলো। গুমোট হয়ে উঠেছে পরিবেশটা। একসময় ঘরোয়া ফুটবলে তানভীরের সতীর্থ পারভেজ বাবু এসে বসে আছেন। খানিক পরই এলেন তানভীরের স্ত্রী শাহ দিল-ই আফরোজ, তাঁর মা ও বাবা শাহ মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। তানভীরের বড় ভাইও এলেন, সঙ্গে তানভীরের এক সাংবাদিক বন্ধু। সবার মুখ মলিন। স্ত্রী আফরোজ তো সেভাবে কথাই বলতে পারছিলেন না। ১২ বছরের জীবনসঙ্গী সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এভাবে ‘কোমায়’ চলে গেছেন, সেটা ভাবতেও পারছিলেন না!
বেদনায় ভারাক্রান্ত তাঁর মন। ঘুম নেই চোখে। তানভীরের কথা তুলতেই পেছন ফিরলেন, ‘নিটল-টাটা প্রথম জাতীয় লিগের সেরা খেলোয়াড় ছিল ও।’ হ্যাঁ, তথ্যটা ওই সময়ের খেলোয়াড়-সাংবাদিক সবারই জানা। বছর ১৫ আগের কথাই তো। প্রায় সব বড় দলেই খেলেছেন। উইংয়ে ছিলেন দুর্দান্ত। পারভেজ বলছিলেন, ‘আরে ও তো নিটল-টাটায় সেরা খেলোয়াড় হয়ে মোটরসাইকেল পুরস্কার পেল।’ ২০০০ সালে জাতীয় দলের ইংল্যান্ড সফরসহ আরও কয়েকটি সফরে ছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে তানভীরের শাশুড়ি যোগ করেন, ‘ও দুবাই, কাতারসহ আরও কয়েকটি দেশে খেলতে গেছে।’
এসব কথার ফাঁকেই কর্তব্যরত চিকিৎসক এসে রোগীর পরিবারকে জানালেন সর্বশেষ অবস্থা। তাতে আশাবাদী হওয়ার তেমন কিছু নেই। চিকিৎসক বললেন, ‘লাইফ সাপোর্ট খুলে দেখতে চেয়েছিলাম স্বাভাবিক শ্বাস নিতে পারে কিনা, পারে না। তাই ভেন্টিলেটরই লাগাতে হলো আবার।’ তানভীর সাড়া দিচ্ছেন মাঝে মাঝে, তবে সেটিকে তাঁর ফিরে আসার বার্তাবাহী বলতে রাজি নন চিকিৎসক। ‘মিরাকল’ কিছু হলেই এ ধরনের রোগী ফিরে আসে। তাই বলে আশা এখনই ছাড়ছেন না ডাক্তার।
সব দেখে মনে হলো, সত্যিই তানভীরের ফিরে আসা হবে ‘মিরাকল’। চিকিৎসক বললেন, পরিস্থিতির উন্নতি হতে অনেক সময় লাগবে। তবে অবনতি হতে সময় লাগে না। সবই এখন সৃষ্টিকর্তার হাতে।
শুনে চোখ ছল ছল করে ওঠে সবার। সঙ্গে দুশ্চিন্তাও। লাখ পাঁচেক টাকা এরই মধ্যে শেষ। স্কয়ারের মতো হাসপাতাল, এত খরচ! তাই তানভীরের শ্বশুর পূবালী ব্যাংকে শাহ দিল-ই আফরোজের নামে একটা সঞ্চয়ী হিসাব খুলেছেন, যেটির নম্বর: ২৪৩৮১০১০৯২৭৫৭। এখন পর্যন্ত ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় ভালো সমর্থন দিচ্ছেন। তানভীরের সতীর্থ ফুটবলার টিটো, কাঞ্চন, মনোয়ার, পারভেজসহ সবাই এগিয়ে এসেছেন। তবে ফুটবল ফেডারেশনের নীরবতা বা অন্য অনেকের উদাসীনতা হতাশায় ঠেলে দেয় দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে বন্দী হওয়া পরিবারটিকে।
স্ত্রী, শাশুড়ি বারবারই আক্ষেপ করছিলেন, ‘ও যে কেন বাসের পেছনের সিট ছেড়ে সামনে এল!’ নাটোর থেকে বাসে ঢাকায় ফিরছিলেন। টিকিট কাটেন পেছনে। কী মনে করে যেন চলে আসেন ড্রাইভারের পেছনে। বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষে তানভীরের পাশের ছেলেটি ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। তানভীরের বুকের ভেতর কাচ ঢুকে গেছে। মাথায় পেয়েছেন প্রচণ্ড আঘাত। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালেন। আর চোখ মেললেন না।
তাঁর চোখ মেলার অপেক্ষায় গোটা পরিবার, বন্ধুরা। ফিরে এসো ভানভীর।