তিতের ছোঁয়ায় মিষ্টি ব্রাজিল

মিষ্টি সময়টা নাকি দ্রুতই চলে যায়। বিশ্বাস না হলে ব্রাজিলের কোনো ভক্তকে জিজ্ঞেস করুন। তিতের অধীনে নয়টি মাস যে চোখের পলকেই চলে গেল! ব্রাজিল ফুটবলের পুনর্জাগরণের নয় মাস।
ব্রাজিলের কোচ হচ্ছেন আদেনোর লিওনার্দো বাচ্চি, সংক্ষেপে তিতে—গত বছরের জুনে যখন ঘোষণাটা এসেছিল, এমন রোমাঞ্চকর যাত্রা কজন অনুমান করতে পেরেছিলেন! কদিন আগেই শতবার্ষিকী কোপা আমেরিকার গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছে ব্রাজিল, যেটির দায় নিয়ে সরে যেতে হয় কার্লোস দুঙ্গাকে। আর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের অবস্থা? দক্ষিণ আমেরিকার দশ দলের মধ্যে ব্রাজিল ছিল ছয় নম্বরে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে নেইমারদের জায়গা করে নেওয়াই তখন হুমকির মুখে।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে বর্তমানে চলে আসুন। স্বাগতিক রাশিয়ার বাইরে ২০১৮ বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত একটি দলই নিশ্চিত—ব্রাজিল! এই নয় মাসে বাছাইপর্বে যে আটটি ম্যাচ খেলেছেন নেইমাররা, জিতেছেন সব কটিতেই। যেখানে এর আগে বাছাইপর্বে ব্রাজিলের টানা জয়ের রেকর্ড ছিল ৬ ম্যাচ (১৯৭০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে)।
নয় মাস আগের ও বর্তমানের সময়টার পার্থক্য? নাহ্, শুধু খেলোয়াড়দের কথা বলা যাচ্ছে না। নেইমার-কুতিনহোরা তো দুঙ্গার দলেও ছিলেন। পার্থক্যটা মাঠের বাইরে। ডাগআউটের ওই সাদা চুলো ৫৫ বছর বয়সী মানুষটি। তিতে!
দায়িত্ব নিয়ে এখন পর্যন্ত শতভাগ জয়ের রেকর্ড ধরে রেখেছেন। শুধু কি জয়-পরাজয়! তিতের ব্রাজিল আবার আনন্দের অন্য নাম। কিংবদন্তি পেলে যে ‘জোগো বোনিতো’র কথা বলেন, ততটা সুন্দর হয়তো নয়, তবে চেনা সেই রোমাঞ্চ অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছেন তিতে। ছন্দোবদ্ধ, মনকাড়া, নিখাদ ব্রাজিলিয়ান!
এত অল্প সময়ে কীভাবে তা সম্ভব করেছেন তিতে? কীভাবে হলো এই পুনর্জাগরণ? ক্লাব ফুটবলে করিন্থিয়ানসের হয়ে ব্রাজিলিয়ান লিগ, কোপা লিবার্তাদোরেস ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জেতার অভিজ্ঞতার ‘পুঁজি’ ছিল। পাশাপাশি নিজের পছন্দের কোচ কার্লো আনচেলত্তি ও পছন্দের দল ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিলের দর্শনও টেনে এনেছেন তিতে। আনচেলত্তির মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন বন্ধুর মতো। আর দলটাকে যেন খেলাচ্ছেন বিরাশির বিশ্বকাপের দলের আদর্শে—তারকা থাকবে, থাকবে ব্যক্তিগত ঝলকও, তবে দল খেলবে একটা ‘দল’ হয়ে।
আতশি কাচে দেখলে তিতের ব্রাজিলের যে বদলগুলো চোখে পড়বে—
তাঁর পছন্দের ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে খেলাচ্ছেন দলকে। যে ছকে দুই ‘১’-এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার সামনে থাকা স্ট্রাইকারের কাজ শুধুই গোল করা নয়, প্রতিপক্ষকে প্রেসিংয়ের কাজও তাঁকে দিয়েই শুরু। গ্যাব্রিয়েল জেসুস এই ‘ডিফেন্সিভ ফরোয়ার্ডে’র ভূমিকায় বেশ দক্ষ। আর চোটের কারণে ম্যানচেস্টার সিটির ১৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড ব্রাজিলের সর্বশেষ দুটি ম্যাচে না থাকায় তাঁর জায়গায় তিতে খেলিয়েছেন কাকে? একই কাজ যিনি খুব ভালো করেন লিভারপুলের হয়ে—রবার্তো ফিরমিনো। আর ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে রক্ষণ ও মাঝমাঠের ভারসাম্যটা রাখার জন্য কাসিমেরো তো আছেনই, যে দক্ষতা তাঁকে রিয়াল মাদ্রিদে জিনেদিন জিদানেরও এত পছন্দের বানিয়েছে।
বলুন তো, ব্রাজিলের নিয়মিত অধিনায়ক কে? উত্তর যা-ই মনে আসুক না কেন, সেটি ভুল। তিতের ব্রাজিলে কোনো একজন অধিনায়ক নেই, বরং দলে কয়েকজন নেতা গড়ে তুলতে চাইছেন ব্রাজিল কোচ। বাছাইপর্বের আট ম্যাচেই অধিনায়কের বন্ধনী তুলে দিয়েছেন ছয় ভিন্ন খেলোয়াড়ের বাহুতে (নেইমার, মিরান্ডা, ফার্নান্দিনহো, দানি আলভেস, ফিলিপে লুইস ও রেনাতো অগুস্তো)।
সুন্দর ফুটবল, আক্রমণ, সৃষ্টিশীলতা সবই ঠিক আছে; কিন্তু তিতের ব্রাজিলের শক্তি রক্ষণও। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একবার বলেছিলেন, ‘আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, রক্ষণ জেতাবে শিরোপা।’ তিতেও এটিকেই যেন মন্ত্র মানেন। প্রমাণ? তিতে-যুগে মাত্র দুটি গোল খেয়েছে ব্রাজিল। কলম্বিয়ার সঙ্গে ২-১ গোলে জয়ের ম্যাচে, এরপর উরুগুয়ের বিপক্ষে ৪-১ গোলে জয়ের ম্যাচে।
মিডফিল্ডে পাওলিনহোকে যেন নতুন করে জাগিয়ে তুলেছেন তিতে। মাঝে দুই বছর ইংলিশ ক্লাব টটেনহামে খাবি খেয়ে পাড়ি জমিয়েছেন চীনের ক্লাব গুয়াংজু এভারগ্রান্দেতে, একই ‘ফর্ম’ ছিল ব্রাজিলের জার্সিতেও। সেই পাওলিনহোই তিতের অধীনে দারুণ উজ্জ্বল, উরুগুয়ের সঙ্গে তো হ্যাটট্রিকই করলেন!
ফিফাডটকম অবলম্বনে

তিতে নিজে কী বলেন
‘আমার কাছে মনে হয়, দলকে যেভাবে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারি তা হলো, যে নীতিগুলো আমাকে জীবন ও ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে, সেগুলোই মাঠে প্রয়োগ করি: স্বচ্ছতা, সবাই মিলে কাজ করা, দক্ষতা ও আধুনিকতা। আমি ফুটবলের যে চিন্তাধারার মানুষ, সেখানে ‘পাস অ্যান্ড মুভ’, ‘গিভ অ্যান্ড গো’, ত্রিভুজ তৈরি করে খেলা, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় আর শেষ প্রান্তে (প্রতিপক্ষের বক্সে ও এর আশপাশে) সৃষ্টিশীলতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খেলোয়াড়েরা শারীরিকভাবে একটু কম শক্তিশালী হলেও সমস্যা নেই, যদি তাঁদের নড়াচড়া দ্রুত হয়, দ্রুত জায়গা বদল করে নিতে পারে।’

তিতেকে নিয়ে নেইমার
তিতে আমাদের দলটাকে একেবারে সঠিক উপায়েই গড়ে তুলছেন। ব্রাজিলিয়ান উপায়ে। আমরা এখন ফুটবলটা যেভাবে খেলা উচিত, সেভাবেই খেলছি। মনে হয় না অত বেশি খেলোয়াড় তিনি বদলেছেন (দুঙ্গার সময়ের চেয়ে)। আমরা শুধু খেলার ধরনটাই বদলেছি। সব সময় যেমন বলি, ব্রাজিলে উঁচু মানের অনেক খেলোয়াড় আছে এবং সেটিই আমাদের এত ভালো করার প্রধান কারণ।