তাঁদের এক বিন্দুতে নিয়ে এলেন রোনালদো। সদ্য সন্তানহারা হয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। প্রেমিকা জর্জিনা রদ্রিগেজের কোলজুড়ে যমজ সন্তান আসার কথা, সে দুজনের একজন পৃথিবীর মুখ দেখলেও, রোনালদোদের মনে যুগপৎ আনন্দ ও বিরহের দোলা দিয়ে অন্যজন গর্ভেই মারা গেছে। রোনালদো আর তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে ম্যাচের সাত মিনিটে উঠে দাঁড়াল পুরো অ্যানফিল্ড। করতালিতে মুখরিত করে তুলল চারপাশ। পুরো এক মিনিট ধরে।
শুধু তাই নয়, হাততালি দেওয়ার পাশাপাশি রোনালদোর উদ্দেশে লিভারপুল–সমর্থকেরা গাইলেন সেই বিখ্যাত গান, ‘তুমি কখনো একা হাঁটবে না (ইউ উইল নেভার ওয়াল অ্যালোন)।’ মাঠের লড়াইয়ে শত্রু হয়েছে তো কী হয়েছে? ব্যক্তিগত জীবনের এমন যাতনাময় সময়ে যে ফুটবল বড়ই তুচ্ছ! সে যন্ত্রণাদায়ক সময়ের মাঝেই রোনালদো আর তাঁর পরিবার যেন একটু হলেও মানসিক প্রশস্তি পান, সে কারণে এক মিনিটের জন্য শতাব্দী-পুরোনো বৈরিতা ভুলে গেলেন লিভারপুল–সমর্থকেরা। কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে গানে-করতালিতে রোনালদোকে জানালেন, ‘এ লড়াইয়ে তুমি একা নও, তুমি কখনো একা হাঁটবে না রোনালদো!’
ওদিকে ইউনাইটেড–সমর্থকেরাও নিজেদের সবচেয়ে বড় তারকার মনে শক্তি জোগানোর জন্য গাইতে থাকলেন, ‘ভিভা রোনালদো!’এক সমর্থককে দেখা গেল, রোনালদোর সাত নম্বর জার্সি হাতে গান করছেন আবেগের সবটুকু দিয়ে।
এ এক অভাবনীয় দৃশ্য, যা দেখার জন্য রোনালদো হয়তো সশরীর উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু পরিবারের সঙ্গে বাসায় বসে দুই দলের যুযুধান–সমর্থকদের এই দৃশ্য যখন দেখবেন, গর্বে বুকটা ফুলে উঠবে নিশ্চিত। জীবন যে ফুটবলের চেয়েও অনেক অনেক বড়!
তবে এমন যে হবে, সেটা ম্যাচের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘অল রেডস’ সমর্থকেরা। সাত মিনিটের অভিনব ওই দৃশ্য তাই একরকম পূর্বপরিকল্পিতই। লিভারপুল–সমর্থকদের এই উদ্যোগে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বার্সেলোনা, টটেনহাম ও লেস্টারের সাবেক ফুটবলার ও ফুটবল-বিশেষজ্ঞ গ্যারি লিনেকার যেমন লিখেছেন, ‘রোনালদোর জন্য খুবই সুন্দর, হৃদয় নিংড়ানো ও অসাধারণ করতালি। খুব ভালো করেছ লিভারপুল!’
টিভি ব্যক্তিত্ব পিয়ার্স মরগান লিখেছেন, ‘মাঠের ভেতরে ও বাইরে লিভারপুল দুর্দান্ত ছিল। নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রুপক্ষের কোনো খেলোয়াড়ের জন্য যে এভাবে সমর্থন দেওয়া যায়, এমন কিছু এর আগে কখনো দেখিনি। লিভারপুল-ভক্তরা খুবই ভালো করেছে, আমি নিশ্চিত রোনালদো ও তাঁর পরিবারের কাছে এর মূল্য অনেক বেশি হবে।’
দল চার গোলে জিতেছে, নিজেদের মাঠে ইউনাইটেডের ওপর রীতিমতো ছড়ি ঘুরিয়েছে, চাইলেই এ ম্যাচ থেকে পছন্দের মুহূর্ত খুঁজতে বলা হলে অনেক মুহূর্তই পেতেন লিভারপুলের ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ।
কিন্তু মাঠের শ্রেষ্ঠত্ব বাদ দিয়ে ক্লপের কাছেও ম্যাচের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত হয়ে রইল দুই দলের সমর্থকদের এভাবে এক হয়ে মিশে যাওয়ার ব্যাপারটাই, ‘জানি আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অসাধারণ এক ফলাফল অর্জন করেছি, তাও আমাকে জিজ্ঞেস করলে, আমি ম্যাচের সেরা মুহূর্ত হিসেবে সাত মিনিটে আমাদের সমর্থকদের করতালির ব্যাপারটাই বলব। লিভারপুল–সমর্থকেরা নিজেদের জাত চিনিয়েছে। পুরো স্টেডিয়ামই নিজেদের মান দেখিয়েছে। জীবনের অনেক কিছুই ফুটবলের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই গতকাল থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
আসলেই জীবন ফুটবলের চেয়ে অনেক বড়। না হয় যে ফুটবল দুই দলের বিভেদ মেটাতে পারেনি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, জীবন এসে কীভাবে একনিমেষে ঘুচিয়ে দেয় সব?