ধন্যবাদ, শুধু 'ধন্যবাদ'!

দমবন্ধ এক রুদ্ধদ্বার ঘরে আচমকা জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া ঢুকলে যে অনুভূতি হয়, দেশের ফুটবলে যেন ছুঁয়ে গেল তেমনই এক ভালো লাগা। আমরা যারা ফুটবল সাংবাদিক, তাদেরই কি ভালো লাগে একের পর এক নেতিবাচক খবর লিখতে? বাফুফের সমালোচনা করে করে কি-বোর্ড ক্ষয় করতে?

ফুটবলের নেতিবাচক খবরে চারপাশ যখন সয়লাব, তখন অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো জয় তো সেই দমকা হাওয়ারই পরশ। প্রথমে তিন গোল খেয়ে পরে পাল্টা চার গোল দিয়ে তুলে নেওয়া বলেই হয়তো আলোচনা হচ্ছে বেশি। পাঠকেরা কেউ ঠোঁট উল্টে বলতেও পারেন, সাধের এক জয় পেয়েছে, তা-ই নিয়ে কত আদিখ্যেতা দেখো!

আসলে ফুটবলকে যাঁরা ভালোবাসেন, একের পর এক মন খারাপ করে দেওয়া খবরের ছাইগাদায় বসে কালকের ম্যাচটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই বোধ হয় আবেগতাড়িত। খেলা, ম্যাচ কিংবা ফলের ধরনটাই বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য অভাবিত।

প্রথমার্ধে তিন গোল হজম ছিল বাংলাদেশের জন্য দগদগে ক্ষত। পরে একের পর এক গোল শোধ করে সেই ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে বাংলাদেশের যুবারা। শেষ বাঁশি বাজার আগে এল জাফর ইকবালের জয়সূচক গোলের আঁচড়। সেটা ভারতের জন্য হয়ে রইল পাল্টা দগদগে ঘা। এ জয় অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়! জাফর ইকবাল, রহমত মিয়া, সুফিলরা শুধু একটি জয়ই উপহার দেয়নি, টানা ব্যর্থতায় ন্যুব্জ দেশের ফুটবল-পালে এনে দিয়েছে এক চিলতে আশার হাওয়া। দমবন্ধ পরিস্থিতিতে এ যেন হাঁ করে একটু নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ, সাজিয়ে রাখা গেলে ফুটবলপ্রেমী বাঙালি হয়তো এ বিজয়কে শোকেসে সাজিয়ে রাখত!

অনূর্ধ্ব-১৫ কচিকাঁচার আসর বাদ দিলে বাংলাদেশ শেষ কবে জিতেছিল, তা মনে করা দুষ্কর। গত বছরের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শেষ জয় পেয়েছিল জাতীয় ফুটবল দল। এরপর পেরিয়ে গেছে বিশ্বকাপ, এশিয়ান কাপ ও এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ বাছাইপর্ব। কোনো সুসংবাদ নেই। উল্টো দুর্বল ভুটানের কাছে হেরে ‘গেল গেল, সব গেল’—যে রব উঠেছিল ফুটবলে, তা আরও বেশি করে চাউর হয় গত মাসে অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা খোয়ানোর পর।

ব্যর্থতার ওপর ব্যর্থতার ভারে জাতীয় দলের পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেয়ালে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে সাম্রাজ্য গেঁড়ে বসা ভারতকে যুব দলের হারানো সত্যি বড় প্রাপ্তি। হোক না তা বয়সভিত্তিক ফুটবল। ভারতকে হারাতে পারে না বাংলাদেশ—এই টিপ্পনী তো আপাতত থামল। ফলে ভারতীয়দের বিপক্ষে পাওয়া জয়টি পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার সঙ্গে তপ্ত রোদে এক পশলা বৃষ্টিও। থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়াম তার সাক্ষী হয়ে থাকবে অনন্তকাল।

‘চাংলিমিথাং’—নামটি খুব পরিচিত পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ, এই চাংলিমিথাংয়েই কলঙ্কিত হয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবল। কলঙ্কই তো! গত বছর অক্টোবরে এই মাঠেই এশিয়ান কাপের প্রাক-বাছাইপর্বে স্বাগতিক ভুটানের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। সেই কলঙ্কসূচক হারের দাগ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে জাতীয় দল; যার পরিণতিতে সর্বশেষ ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৬।

এবার সেই চাংলিমিথাংয়েই ভারতকে হারিয়ে জাতীয় দলের কলঙ্কমোচন করল যুবারা। এই জয়কে দেশের ফুটবলে ইতিহাসসেরা জয় বললেও অত্যুক্তি হবে না! আর তাই কলঙ্ক এঁকে দেওয়া চাংলিমিথাং এখন গৌরবেরও সাক্ষী। তিন গোল হজমের পর চার গোলের এ জয়ে বাংলাদেশের ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করতে পারে না—সে অপবাদও তো ঘুচল। কোথায়? সেই চাংলিমিথাংয়ে!

একটি জয়ে ফুটবল মানচিত্রে বাংলাদেশের কোনো পরিবর্তন হয়নি, হয়তো কাটবে না দেশের ফুটবলের অচলাবস্থাও। সূচিভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে আসবে কি মৃদু আলোও? কিন্তু দেশের ফুটবল নিয়ে অনেক দিন পরে যে উত্তেজনার আমোদটা ছড়াল, সেটাই এখন বড় স্বস্তি, বড় আনন্দ। মুহূর্তটাকে কতক্ষণ উপভোগ করা যাবে জানি না। আপাতত এই আনন্দটুকু উপহার দেওয়ার কৃতজ্ঞতা হিসেবে এই লম্বা কেচ্ছা ফেঁদে বসা। তাও শুধু একটা শব্দ বলার জন্যই—ধন্যবাদ।