নিভৃতেই ফুটবলের আবাদ হালিমের

ঈশ্বরগঞ্জ বড় মাঠে তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত আবদুল হালিম l ছবি: জগলুল পাশা
ঈশ্বরগঞ্জ বড় মাঠে তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত আবদুল হালিম l ছবি: জগলুল পাশা

সকালের সূর্যটা মাত্রই তেতে উঠেছে। ঈশ্বরগঞ্জ বড় মাঠে ঘণ্টা খানেক আগে জড়ো হয়েছে একদল তরুণ। কারও গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। চেলসি আর বার্সেলোনার জার্সি পরেও এসেছে কেউ কেউ। মাঠের মাঝখানে তখন চলছে ফুটবলের পাঠ। ছাত্ররা সবাই ভীষণ মনোযোগী।
ঈশ্বরগঞ্জ পৌর ঈদগাহর পাশের ওই মাঠে তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে এভাবেই প্রতিদিন জড়ো হন কোচ আবদুল হালিম। কোচের চেয়েও বড় পরিচয়—তিনি জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার। সত্তর-আশির দশকে খেলেছেন কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েত, মেজর হাফিজ, আশরাফউদ্দিন চুন্নুদের সঙ্গে। ময়মনসিংহ জেলা থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া একমাত্র ফুটবলারও হালিম!          
ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন যখন ফিফা, এএফসির কংগ্রেসে নিয়মিতই যোগ দিচ্ছেন, হালিমকে তখন জীবিকার প্রয়োজনে সময় দিতে হচ্ছে ঈশ্বরগঞ্জ শহরের মুঠোফোন ফ্লেক্সিলোড, কম্পিউটার কম্পোজ আর ফটোকপির দোকানে। এরই ফাঁকে চালিয়ে যাচ্ছেন ফুটবল কোচিং।
ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো পেট্রলপাম্পের গলি দিয়ে কয়েক পা এগোলেই আবদুল হালিমের বাড়ি। বাড়ি বলতে দোচালা জীর্ণ একটি টিনের ঘর। পুরোনো ফার্নিচারেও দৈন্যর ছোঁয়া। ঘরের ভেতরে টেবিলের ওপর সাজানো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সম্মাননা স্মারকগুলো ইতিহাসের সাক্ষী দিচ্ছে। খেলোয়াড়ি জীবনের পুরোনো কিছু ছবিও স্মৃতি হিসেবে বাঁধিয়ে রেখেছেন শোকেসের ওপর।
এলাকায় তিনি ‘হালিম আংকেল’ নামেই পরিচিত। পাশের চরনিখলা ও বিশ্বেশ্বরী উচ্চবিদ্যালয়ে জনা ত্রিশেক ফুটবলার প্রতিদিন অনুশীলনে আসেন হালিমের কাছে। কখনো বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফুটবলার খুঁজতে যেতে হয় তাঁকে। সারা দেশের তরুণেরা যেখানে ক্রিকেটে আনন্দ খুঁজছে, ঈশ্বরগঞ্জ সেখানে ব্যতিক্রম। এখানকার বেশির ভাগ তরুণই ফুটবল খেলে। কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ গন্তব্য ময়মনসিংহ জেলা ফুটবল লিগ। ময়মনসিংহের আবাহনী, মোহামেডান বা ফ্রেন্ডস ইলেভেনের হয়েই খেলছেন হালিমের ছাত্ররা।

স্বাধীনতার আগে আন্তস্কুল টুর্নামেন্ট দিয়ে ফুটবলে হাতেখড়ি হালিমের। স্কুলের শারীরিক শিক্ষক নুরুল কাওসার ফুটবলে নিয়ে আসেন তাঁকে। বাবা-চাচা সবাই ফুটবল খেলতেন। হালিমের রক্তেই যেন ফুটবলের বীজ ছিল। অ্যাথলেটিকসে স্কুলপর্যায়ে সেরা ছিলেন হাইজাম্প ও স্প্রিন্টে।

হালিম প্রথম ঢাকায় খেলেন ১৯৭৪ সালে হোল্ডেন একাদশের হয়ে। এরপর পিডব্লুডি, ওয়াপদা, রহমতগঞ্জ, ওয়ারী হয়ে ব্রাদার্সে শেষ করেন ক্যারিয়ার। ১৯৭৬ সালে হয়েছিলেন প্রথম বিভাগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। পিডব্লুডির হয়ে খেলা হালিম ওই মৌসুমে করেন ১৬ গোল। এই কীর্তিই ওই বছরই তাঁকে নিয়ে তোলে জাতীয় দলে, খেলতে যান থাইল্যান্ডে কিংস কাপে। ঢাকায় ১৯৭৯ সালে কাতার, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে হয়েছিল এশিয়ান কাপের আঞ্চলিক বাছাইপর্ব। বাংলাদেশ সেবার রানার্সআপ হয়ে ওঠে চূড়ান্ত পর্বে। ঢাকাতেই ক্যারিয়ারের স্মরণীয় ম্যাচটি খেলেছিলেন হালিম। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪-১ গোলে জেতে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে জোড়া গোল করেছিলেন হালিম। হাঁটুর চোটে পড়ে ক্যারিয়ারটা আর লম্বা হয়নি। তাঁর গোলে বাংলাদেশ এশিয়ান কাপে উঠলেও চোট ১৯৮০ সালে কুয়েতের এশিয়ান কাপে যেতেই পারেননি আবদুল হালিম।

ফুটবল নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। দুই ছেলে শাহাদত হোসেন, আহাদ হোসেনকেও ফুটবলে এনেছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বিভাগের দলগুলোয় খেলেই ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ছেলেরা। বাবার মতো বর্তমানে টুকটাক কোচিং করিয়েই সময় কাটছে তাঁদের। 

দোকান আর কোচিং—এই নিয়েই ব্যস্ত আছেন হালিম। ফুটবল তাঁকে কিছুই দেয়নি। তবু ফুটবল ছাড়া জীবন অচল হালিমের, ‘এখন আমার সময় কাটে তরুণ এই ফুটবলারদের নিয়ে। যত দিন আছি এদের নিয়েই থাকব।’ সাবেক স্ট্রাইকার হিসেবে দেশের ফুটবলের দৈন্যদশা পোড়ায় হালিমকে, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য এই ছেলেদের মধ্যে দেশপ্রেম কম। ওদের ক্লাবের প্রতিই বেশি মায়া, টাকার প্রতি লোভ বেশি।’ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমাদের সময়েও তো বিদেশিরা খেলেছে। কিন্তু বেশি গোল করতাম আমরাই।’

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাননি বলে শেষ বয়সে একটা আক্ষেপ রয়েই গেছে হালিমের। জীবনের খেরো খাতায় সব হিসাব মেলাতে পারেননি হালিম। তবে দোকানে বসে অন্যের মুঠোফোনের রিচার্জের অঙ্কটা মিলিয়ে যাচ্ছেন নির্ভুল।