পঁয়তাল্লিশেও অদম্য মোহাম্মদ আলী

সোমবার সকাল আটটা। নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি রিজার্ভ বাস এসে থামল কমলাপুর স্টেডিয়ামে। একঝাঁক নবীন ফুটবলারের সঙ্গে ওই বাসের যাত্রী মোহাম্মদ আলী। ঢাকা মাঠের বর্ষীয়ান গোলরক্ষককে দেখে এক তরুণ মজা করে বললেন, ‘ফরেনার আইছে, ফরেনার।’

তরুণের দোষ কী! মোহাম্মদ আলী দেখতে অবিকল আফ্রিকানদের মতোই। হতেই পারে, তাঁর শরীরে তো সত্যি সত্যিই আফ্রিকান রক্ত!

সেই রক্ত শরীরে ধারণ করে আলী মাঠের দিকে এগোন অনুশীলন করতে। এই প্রথম খেলবেন ঢাকার ফুটবলে বর্তমানে তৃতীয় স্তর সিনিয়র ডিভিশন বা একসময়ের প্রথম বিভাগে। ৩১ মার্চ ১২ দল নিয়ে তিন বছর পর কমলাপুরে শুরু হবে এই লিগ। তা শুরুর আগেই আলোচনায় আলী। তাঁর ক্লাব স্বাধীনতা ক্রীড়াচক্রের এক কর্মকর্তা আরেক ক্লাব কর্মকর্তার সঙ্গে রসিকতা করেন, ‘আমাগো বারে বল কিন্তু এবার বেশি মাইরো না। বোঝোই তো, বারে থাকব আলী। বয়স হইছে তো ওর!’

পাসপোর্টে জন্মসাল ১৯৭৮। কিন্তু বাস্তবে ১৯৭২ সালের ৩ অক্টোবর। ৪৫ বছর হতে চলল, কিন্তু এখনো ক্লান্তিহীন আলী। গোলরক্ষক হিসেবে নামটি হয়তো বাংলাদেশের ফুটবলে তেমন ঝলমলে নয়। জাতীয় দলে খেলা হয়নি কখনোই। কিন্তু তাঁর মতো এত বেশি বয়সে ঢাকার মাঠে কেউ খেলেননি। ১৯৯৩ সালে বিআরটিসি দিয়ে ঢাকার ফুটবলে অভিষেক। সেই থেকে গত ২৪ বছরে রহমতগঞ্জ, ব্রাদার্স (২০০৩-০৬), বিয়ানীবাজার, আবাহনী (২০১০-১১ ও ১১-১২), মুক্তিযোদ্ধা, ফরাশগঞ্জে খেলেছেন।

ব্রাদার্সের হয়ে দুবার লেবানন গেছেন। গেছেন বাহরাইন, গোয়া, তুর্কমেনিস্তানেও। আবাহনীর হয়ে কম্বোডিয়া সফরের স্মৃতিও আছে। গত বছর পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে চ্যাম্পিয়ন করেছেন ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলকে।

আলী-রথে চড়ে কদিন আগে চট্টগ্রাম প্রথম বিভাগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিসিআইসি। আলীই ছিলেন দলটির অধিনায়ক। এখন নিজ শহরের ক্লাবের হয়ে সিনিয়র ডিভিশনে তাঁর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ। যেখানে সঙ্গী পাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক জাতীয় ফুটবলার আজমল হোসেন বিদ্যুৎকে, যিনি স্বাধীনতা ক্রীড়াচক্রের কোচ কাম খেলোয়াড়।

বিদ্যুৎ অবসরের মেজাজে আছেন। কিন্তু আলীর ফিটনেস এত ভালো হওয়ার রহস্য কী—শরীরে আফ্রিকান রক্ত? আলী সেই গল্পের পৃষ্ঠা উল্টান, ‘আমার নানা ছিলেন নাইজেরিয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাইজেরিয়ার একটি সার্কাস দলের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে আসেন। ওই দলের সবাই সার্কাস শেষ করে নাইজেরিয়া ফিরে গেলেও নানা যাননি। নাইজেরিয়ায় তাঁর পরিবারে সৎমা ছিলেন।’

তারপর? আলীর নানা নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ট্রাস্টে চাকরি নেন। একটা সময় বিয়ে করেন নারায়ণগঞ্জে। সেই ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে এক মেয়ে। ওই মেয়েই আলীর মা সাহারা বেগম। সবাই দেখতে নাইজেরিয়ানদের মতো। বাঙালি সমাজে আফ্রিকান চেহারার মানুষ, তাঁর পরিবার তাই ‘ফরেন ফ্যামিলি’ হয়ে যায় অন্যদের কাছে। কিছুটা বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ে আশপাশ থেকে।

ষাটের মাঝপথে আলীর মায়ের বিয়ে হলো নারায়ণগঞ্জের কৃষক মাহমুদ আলীর সঙ্গে। এই দম্পতির এক মেয়ে ও এক ছেলে। বাহাত্তরে জন্ম নেওয়া সেই ছেলেই এই আলী। নানার নামে তাঁর নাম রাখা হলো। দুর্ভাগ্য নানার, নাতিকে দেখার আগেই মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জে মারা যান।

সময় এগোয়। আলীরা বাংলায় কথা বলেন, আবার আফ্রিকান চেহারা। ব্যাপারটা কী! ‘পুলিশ প্রশাসনও আমাদের দেখে অনেকবার দ্বিধায় পড়েছে’—হাসতে হাসতে বলেন আলী। এখনো তিনি আফ্রিকান ফুটবলার হিসেবে দিব্যি খেলে আসেন দেশের কোথাও। কয়েক বছর আগে জাতীয় দলের সঙ্গে নরসিংদীতে আফ্রিকান একাদশের প্রীতি ম্যাচে খেলেছেন আফ্রিকান একাদশে!

ঢাকা থেকে পাঁচ আফ্রিকান খ্যাপ খেলতে যাবেন এক জেলায়। কিন্তু চার বিদেশি পাওয়া গেল, পঞ্চম বিদেশি নেই। সেই বিদেশি সেজে আলী খেলে এলেন অনায়াসে। ২০০২ সালে গাজীপুর ব্রাদার্সের সঙ্গে সড়কপথে নেপাল যাওয়ার সময় ভারতের রানীগঞ্জ বর্ডারে ইমিগ্রেশন অফিসার শুধু আলীকে তাঁর রুমে বসান। সতীর্থরা এটা দেখে হাসলে আলী তাঁদের বলেন, ‘এই চুপ, তোরা কিছু বলবি না।’ ইমিগ্রেশনে বাড়তি খাতির-যত্ন পেয়েছেন। কারণ আলী বিদেশি!

কিন্তু নানার শেকড়ের কোনো সন্ধান তাঁদের কাছে নেই। নাইজেরিয়ান কোচ লাডি বাবালোলা একবার আলীকে বলেছিলেন, নাইজেরিয়ায় তাঁর নানার বংশের কারও ঠিকানা থাকলে দিতে। সেটা দিতে পারেননি। অথচ নানার সূত্র ধরে আফ্রিকান উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন। হয়তো আরও কয়েক প্রজন্ম তা চলবে।

‘আফ্রিকান’ হওয়ার যেমন সুবিধা পেয়েছেন ফুটবলে, হ্যাপাও কম নয়। যাঁর সঙ্গে প্রেম করতেন, সেই প্রেমিকার পরিবার বিয়ে দেবে না ‘আফ্রিকান ছেলে’র কাছে। তখন নারায়ণগঞ্জে ভাড়া থাকেন আলীরা (ফুটবল খেলে এখন শীতলক্ষ্যার তামাকপট্টিতে দোতলা বাড়ি করে স্থায়ী বাসিন্দা)। শেষে প্রেমিকার অদম্য ইচ্ছায় বিয়েটা হয়েছে পরিবারের অমতে। এই দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছেন। তিনিও দেখতে আফ্রিকানের মতো। কদিন পর মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেও খেলে যাবেন? গোলরক্ষক মহসীনের ভক্ত আলী জবাব দেন, ‘শরীরে কুলোলে খেলব। ভালোই তো হবে, মেয়ের জামাইও দেখবে শ্বশুর ফুটবল খেলছে, হা হা হা!’