প্রিয় কোচের পুরস্কার নিয়ে কাঁদলেন সাবিনা

কোচের হয়ে পুরস্কারটা হাতে নিয়ে আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি সাবিনা। কাঁদতে কাঁদতে মঞ্চ ছেড়েছেনছবি: সংগৃহীত

পুরস্কারটি হাতে পেলে কী করতেন, সে আভাস মিলছিল মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই। সাতক্ষীরার ফুটবল কোচ আকবর আলী স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন কুল–বিএসপিএর পুরস্কার নিতে। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির তৃণমূল সংগঠকের পুরস্কারের মনোনয়ন পাওয়া মফস্বলের এই কোচ পাঁচ তারকা হোটেলের জাঁকজমক আর রঙিন আলোর রোশনাইয়ে এসে একটু হলেও মুগ্ধ হতেন।

তাঁর সেই মুগ্ধতা রং ছড়াত হলভর্তি মানুষের মুহুর্মুহু করতালিতে। কিন্তু ঢাকায় যখন আকবর আলীর নামে তৃণমূল সংগঠকের পুরস্কার ঘোষণা করছিলেন সঞ্চালক, তখন প্রয়াত এই কোচের শেষ যাত্রার আনুষ্ঠানিকতা চলছিল সাতক্ষীরায়। গতকাল ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনন্তলোকের পথে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।

তৃণমূলের ফুটবলের জন্য নিভৃতে কাজ করে গেছেন আকবর আলী। বলা যায় তৃণমূলের নিঃস্বার্থ একজন কোচ ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুনের কোচ।

মাত্র ৪৮ বছর বয়সেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন আকবর আলী
ছবি: সংগৃহীত

ফুটবলে এমন অনেক সাবিনা গড়ে উঠেছেন আকবর আলীর হাত ধরে। কখনো তিনি কোচ, কখনো বাবার ভূমিকায়। নিজের দুই মেয়েকে ফুটবলার বানিয়েছেন। ফুটবলার তৈরির কারখানা খুলে বসেছিলেন। সাতক্ষীরায় তৈরি করেছিলেন জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামের ফুটবল একাডেমি।

সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিজের আগ্রহে ফুটবল মাঠে নিয়ে যেতেন। নিজের বাড়িতে রেখে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন। শুধু খেলা নয়, পড়াশোনার খরচও মেটাতেন খেলোয়াড়দের। ফুটবলার সাবিনাই নয়, দেশের ফুটবলের প্রথম পেশাদার নারী কোচ ও সাবেক ফুটবলার মিরোনা খাতুন, জাতীয় দলের ফুটবলার সুরাইয়া খাতুন, মাসুরা পারভীনদেরও কোচ ছিলেন আকবর আলী। জাতীয় কাবাডি দলে খেলা একাধিক নারী খেলোয়াড় আকবর আলীর হাতে তৈরি। দেশের সাবেক দ্রুততম মানবী শিরিন এবং নিজের যমজ মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ও ফাতেমা তুজ জোহরাও ছিলেন আকবর আলীর হাতে গড়া।

আজ যখন অনুষ্ঠানের হলরুমের বড় পর্দায় আকবর আলীকে দেখানো হচ্ছিল, শোক ছড়িয়ে পড়ছিল সবার মাঝে। ৪৮ বছর বয়সী এই কোচের মৃত্যুতে শোক বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীনের, ‘আমি যখন ঘুম থেকে উঠে শুনলাম খবরটা, খুবই খারাপ লাগল। একজন মানুষ সারা জীবন ধরে যে কাজ করে গেলেন, সেই স্বীকৃতি হাতে তুলতে পারলেন না, এটা খুব বেদনাদায়ক। তবে মৃত্যুর আগে জেনে গিয়েছিলেন যে তিনি স্পেশাল। কাজের স্বীকৃতি যে পাচ্ছেন, সেটা উনি জেনে গিয়েছিলেন।’

বাংলাদেশের ফুটবল দলের মেয়েদের বেশিরভাগই আকবর আলীরই হাতে গড়া
ছবি: সংগৃহীত

আকবর আলীর বাড়িতে চলছে কান্নার মাতম। এমন পরিস্থিতিতে কেউ পুরস্কার নিতে ঢাকায় আসতে পারেননি। বিএসপিএর সিনিয়র সদস্য ও সাবেক সভাপতি আবদুল তৌহিদের হাত থেকে প্রিয় কোচের পুরস্কার গ্রহণ করেন সাবিনা খাতুন। পুরস্কার হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাতীয় দলের ফুটবলার। উপস্থাপক তাঁকে কিছু বলার অনুরোধ করলে কান্নায় কণ্ঠ ভারী হয়ে আসছিল সাবিনার। কোনো কথা না বলে চোখ মুছতে মুছতে দর্শক সারিতে চলে আসেন সাবিনা।

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চলেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হয়েছে ভিনদেশি কোচদের নিয়ে ফ্যাশন শো। কিন্তু এত আনন্দের মাঝে বারবার প্রিয় কোচের মুখ ভেসে উঠছিল সাবিনার মনে।

তাই তো অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগে সাবিনা এক ফাঁকে অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে পড়েন। তবে যাওয়ার আগে বলছিলেন, ‘এই পুরস্কার নিতে কতখানি খারাপ লেগেছে সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। অথচ আজ এই পুরস্কার নেওয়ার ঘটনায় ভিন্ন কিছু হওয়ার কথা ছিল। তাঁদের মতো মানুষ আছেন বলেই আমরা একেকজন সাবিনা, শিরিন হতে পেরেছি। তাদের মতো কোচরা যে পরিশ্রম করেছেন, সেই প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি আমরা। উনাদের মতো কোচ আরও অনেক কিছু পাওয়ার যোগ্য। এই পুরস্কার দিয়ে হয়তো সেটা পূরণ করা যাবে না। আমরা সব ছাত্রী যদি স্যারের সামনে বসে পুরস্কার নিতে পারতাম, তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হতো না।’