ফুটবলে দাদুদের একাদশ
মিসরের ফুটবলে তাঁকে কেউ চেনে না বললেই চলে। সেই এজ এলাদিন বাহদেরের সঙ্গে দেশটির তৃতীয় বিভাগের একটি দল চুক্তি করেছে গত জানুয়ারিতে। অজানা কোনো ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি করাটা অন্যায় নয়। তবে বাহদেরকে চুক্তি করে অন্যরকম একটি রেকর্ডই হয়তো গড়েছে মিসরের ক্লাবটি। মিসরীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) দাবি, পেশাদার ফুটবলের ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার বাহদের। তাঁর বয়স যে ৭৪ বছর! মিসরীয় এবং বাহদেরের পক্ষ থেকে গিনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লেখানোর জন্য আবেদনও করা হয়েছে।
সম্প্রতি জাপানের জে-লিগের দল ইয়োকোহামা এফসির হয়ে আরও একটা মৌসুম খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন ৫৩ বছর বয়সী কাজুইয়োসি মিউরা। কোনো ফুটবলারের বয়স ৩০ পেরোলেই ধরে নেওয়া হয় তাঁর ক্যারিয়ারের সায়াহ্নবেলা এসে গেছে। কিন্তু ৪০ পেরিয়েও প্রতাপের সঙ্গে খেলেছেন এমন ফুটবলারের সংখ্যাও কম নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে ফুটবল দাদুদের একটা একাদশই হয়ে যায়। দেখে আসা যাক সেই একাদশ!
রজার মিলা, ৪৪ বছর
১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের হয়ে চারটি গোল করেছেন রজার মিলা। প্রত্যেকটি গোলের পরই অন্যরকম নাচে তাঁর উদ্যাপনের দৃশ্য এখনো হয়তো অনেকের মনে অমলিন। সেই সময়ে তাঁর বয়স কত ছিল জানেন? ৩৮ বছর। অনেকেই তখন হয়তো ধরে নিয়েছিল, এটাই মিলার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিলা ক্যামেরুনের হয়ে খেলতে গেলেন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও! সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়া ক্যামেরুনের হয়ে ৪২ বছর বয়সী মিলা একটি গোল করেছেন। সেই বিশ্বকাপে অবশ্য মিলার পারফরম্যান্সের চেয়ে তাঁর বয়স নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। অনেকেরই ধারণা ছিল, মিলা যত বলেছেন তাঁর বয়স আসলে এর চেয়েও বেশি ছিল! ১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর আরও দুই বছর ফুটবল খেলেছেন মিলা, ১৯৯৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার ক্লাব পুত্রা সামারিন্দার থেকে অবসরে গেছেন তিনি।
মার্কো বাল্লোত্তা, ৪৩ বছর
লাৎসিওর হয়ে দুই মেয়াদে ছয় মৌসুম খেলেছেন মার্কো বাল্লোত্তা। ২০০৫ থেকে ২০০৮—দ্বিতীয় মেয়াদে খেলেছেন এই তিন মৌসুম। ১৯৮২ সালে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করা সাবেক এই গোলকিপার ২০০৮ সালে লাৎসিও থেকেই ফুটবল থেকে বিদায় জানিয়েছেন। ২০০৭ সালে ৪৩ বছর বয়সে দলটির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছেন। সেবার তিনি চ্যাম্পিয়নস লিগের বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়ের রেকর্ডও গড়েন। সেই সময়ের অন্যতম সেরা গোলকিপার আরেকটা কারণেও বিখ্যাত ছিলেন। ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসে মাথায় খুব বেশি চুল আর অবশিষ্ট ছিল না ইতালিয়ান গোলকিপারের। কিন্তু ওই অল্প চুলই বাল্লোত্তা নীল রং করে রেখেছিলেন লাৎসিওর নীল রংকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে!
রিভালদো, ৪৩ বছর
১৯৯৯ সালে রিভালদো ব্যালন ডি’অর জিতেছেন ২৭ বছর বয়সে। ২০০২ সালে ব্রাজিলের হয়ে যখন বিশ্বকাপ জেতেন, রিভালদোর বয়স ৩০ বছর। তখনো কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে রিভালদোকে ২০১৫ সালেও পেশাদার ফুটবলে খেলতে দেখা যাবে! পাঁচ বছর আগে ব্রাজিলের ক্লাব মোগি মিরিমের হয়ে তো ছেলে রোনালদিনিওর সঙ্গেও খেলেছেন রিভালদো।
আন্দ্রেয়া পিয়েরোবন, ৪৫ বছর
ভালোবেসে মানুষ তাঁকে ‘নোনো’ বলে ডাকত। ইতালিয়ান শব্দটির বাংলা অর্থ দাদু! এই নামে তাঁকে ডাকবে নাই-বা কেন, ইতালির ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক পেশাদার ফুটবলার ছিলেন সাবেক এই গোলকিপার। ম্যারাডোনার সেই ‘হ্যান্ড অব গড’-এর বছরে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন আন্দ্রেয়া পিয়েরোবন। শুরু যে ক্লাব দিয়ে করেছেন, ২০১৫ সালে শেষও করেছেন সিরি ‘বি’র সেই ক্লাব সিত্তাদেল্লার হয়ে।
জন বারিজ, ৪৬ বছর
২৮ বছরের পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার তাঁর। প্রায় তিন দশকের ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৩৪টি ক্লাবে। এর মধ্যে আছে ম্যানচেস্টার সিটি, নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মতো দলও। ৪৬ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ডের ষষ্ঠ স্তরের দল ব্লিথ স্পার্টানস থেকে অবসর নেন ইংলিশ গোলকিপার। এর আগেই অবশ্য একটি রেকর্ড গড়েছেন প্রিমিয়ার লিগে। ১৯৯৫ সালে ৪৩ বছর বয়সে ম্যান সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন। সেই সময়ে রেকর্ড গড়েছেন প্রিমিয়ার লিগে খেলা সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়ের।
এসাম এল হাদারি, ৪৭ বছর
রাশিয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপে মিসর দল নিয়ে বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমীদের আগ্রহ ছিল মোহাম্মদ সালাহকে ঘিরে। কেউ কেউ অবশ্য মিসরের বেঞ্চেও নজর রেখেছিলেন। সেখানে যে ছিলেন এসাম এল হাদারি! একজন রিজার্ভ গোলকিপারের দিকে নজর রাখার কী ছিল! কোনো এক ম্যাচে মাঠে নামলেই যে বিশ্বকাপের একটি রেকর্ড গড়ে ফেলবেন হাদারি। সৌদি আরবের বিপক্ষে মাঠে নেমে সেই রেকর্ডটি গড়েও ফেলেছেন তিনি। ৪৫ বছর বয়সী গোলকিপার হয়ে গেছেন বিশ্বকাপে খেলা সবচেয়ে বয়সী ফুটবলার। উপলক্ষটি তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে।
হাদারির বয়স এখন ৪৭ বছর। এখনো খেলে যাচ্ছেন তিনি, মিসরের দ্বিতীয় বিভাগের দল নুগমে।
টেডি শেরিংহাম, ৪৯ বছর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহাম হটস্পারের সাবেক স্ট্রাইকার টেডি শেরিংহাম ২০০৮ সালে পেশাদার ফুটবলকে একবার বিদায় জানিয়েছেন। তবে ২০১৫ সালে আবার পেশাদার ফুটবলে ফেরেন স্টিভেনেজর কোচ কাম খেলোয়াড় হয়ে। সেই সময়ে ৪৯ বছর বয়সী শেরিংহাম অবশ্য দলটির হয়ে একবারও মাঠে নামেননি। তা যাই হোক, ওয়েস্ট হামের হয়ে ৪০ বছর ২৬৮ দিন বয়সে গোল করে প্রিমিয়ার লিগের বয়োজ্যেষ্ঠ গোলদাতার রেকর্ডটি তাঁরই অধিকারে।
সক্রেটিস, ৫০ বছর
ব্রাজিলের হলুদ-নীল থেকে গ্রাফোর্থ টাউনের হলুদ-নীল জার্সিতে! ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলকে নেতৃত্ব দেওয়া সক্রেটিসের ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। ১৯৮৯ সালে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে কোচিংয়ে পা রেখেছিলেন সক্রেটিস। ১৯৯৯ সালে কোচিং থেকেও সরে দাঁড়ান। সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন আবার ফুটবলে ফেরেন ২০০৪ সালে। তাও আবার পেশাদার ফুটবলার হিসেবে।
ইংল্যান্ডের নন-লিগের দল গ্রাফোর্থ টাউনের সঙ্গে এক মাসের চুক্তি করেন কিংবদন্তি ফুটবলার। দলটির হয়ে একটি ম্যাচই খেলেছেন সেই সময়ে ৫০ বছর বয়সী সক্রেটিস।
স্ট্যানলি ম্যাথুস, ৫০ বছর
নাইট উপাধি পাওয়া প্রথম ফুটবলার স্ট্যানলি ম্যাথুস শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলেছেন। ব্ল্যাকপুলের সাবেক উইঙ্গার ১৯৬১ সালে নাম লেখান স্টোক সিটিতে। সেখান থেকে ১৯৬৫ সালে ধারে খেলতে যান টরন্টো সিটিতে। সে বছরই বিদায় জানান পেশাদার ফুটবলকে। ম্যাথুস ফুটবলপ্রেমীদের মনে বেশি জায়গা করে নিয়েছেন ‘ম্যাথুসের ফাইনাল’-এর জন্য। ১৯৫৩ সালে এফএ কাপের সেই ফাইনালে ৩-১ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল তাঁর দল ব্ল্যাকপুল। শেষ পর্যন্ত বোল্টনের বিপক্ষে ম্যাচটি তারা জিতেছিল ৪-৩ গোলে। দলকে জেতাতে হ্যাটট্রিক করেছেন মর্টেনসেন। কিন্তু ফাইনালটির নাম হয়ে গেছে ‘ম্যাথুসের ফাইনাল’! তাঁর অসাধারণ পারফরম্যান্সেই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল ব্ল্যাকপুল। দলের ৪ গোলের ৩টিই ছিল তার সহায়তায়।
কাজুইয়োশি মিউরা, ৫৩ বছর
এটা যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে—নতুন একটি বছর আসবে, কাজুইয়োশি মিউরা ইয়েকোহামা এফসির সঙ্গে নতুন চুক্তি করবেন! ৫০, ৫১, ৫২...বয়স কোনো ব্যাপারই যেন নয় তাঁর কাছে! এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ‘কিং কাজু’ আবার নতুন চুক্তি করেছেন ইয়োকোহামার সঙ্গে। ১৯৮২ সালে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করা কাজুর বয়স এখন ৫২ বছর।
রজার মিলা, রিভালদো, সক্রেটিস, ম্যাথুস, কাজু...১০ ফুটবল দাদুর ঠিকুজি তো পেলেনই। এঁদের সবার ‘ড্যাড’ই বলা যায় ৭৪ বছর বয়সী এজ এলাদিন বাহদেরকে। ফুটবল দাদুদের একাদশ তো হয়েই গেল। বয়সে এগিয়ে থাকায় দলটির নেতৃত্ব বাহদেরেরই পাওয়ার কথা!