ফুটবলে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে থাকা সেই দলই...

প্লে অফ সেমিফাইনালে ইতালিকে বিদায় করে দিল উত্তর মেসিডোনিয়া। উদ্‌যাপনটাও হলো বুনোছবি: রয়টার্স

ফুটবল ঠিক কতটা নাটকীয়? একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১৬ সালে প্যারিসে ইউরো জেতে পর্তুগাল। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে উত্তর মেসিডোনিয়া তখন ভারতেরও পেছনে।

ভারত ১৩৫তম আর দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশটি ১৬২তম। ছয় বছর পর দেখা যাচ্ছে, পর্তুগালের কাতার বিশ্বকাপে খেলার পথে বাধা এখন সেই উত্তর মেসিডোনিয়া! সেবার ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা ইতালিও কি এই ছয় বছরে ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেয়েছে, পুঁচকে দেশটি তাদের স্বপ্নভঙ্গে গোকুলে বেড়েছে!

পার্লেমোয় কাল রাতে ফুটবল–বিশ্বে উত্তর মেসিডোনিয়া ঠিক কত রিখটার স্কেলে ‘ভূকম্পন’ঘটিয়েছে, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলার কথা। ধাক্কার গভীরতা কতটা, তা কি এখনো বুঝে ওঠা গেছে? ইতালি চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, গত বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই এবার খিদেটা আরও বাড়ার কথা।

ইউরো জিতে তার প্রমাণও দিয়েছে রবার্তো মানচিনির দল। কিন্তু বিশ্বকাপ বাছাইয়ে দেখা গেল, ৬৭তম র‌্যাঙ্কিংয়ের উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে প্লে–অফ সেমিফাইনাল হারল ইতালি! ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বর্তমানে ৬ নম্বর দলকে দেখা যাবে না বিশ্বকাপের টানা দুই সংস্করণে। ভাবা যায়!

ইতালিকে শেষ মুহূর্তের গোলে হারিয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতে ওঠেন উত্তর মেসেডোনিয়ার খেলোয়াড়েরা
ছবি: রয়টার্স

কাল রাতে প্লে–অফ সেমিফাইনাল শুরুর আগে সমীকরণ করাই ছিল অনেকের। প্লে–অফ সেমিফাইনালে এক পাশ থেকে উঠবে পর্তুগাল, অন্য পাশ থেকে ইতালি। তা, এক পাশের হিসাব ঠিকই মিলেছে, তুরস্ককে কষ্টেসৃষ্টে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছে পর্তুগাল। কিন্তু অন্য পাশের হিসাবটা মেলেনি।

ফাইনালে ইতালিকে পাওয়ার হিসাব কষা পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোসকে এখন উত্তর মেসিডোনিয়াকেও সমীহ করতে হচ্ছে, ‘ইতালিকে আমরা যতটা সমীহ করতাম, তা এখন উত্তর মেসিডোনিয়াকেও করতে হবে।’

মেসিডোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ২০ লাখ। রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণে অনেকে সমীহ করতে পারেন। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর উত্তর মেসিডোনিয়ার জন্ম হয়। একসময় শুধু মেসিডোনিয়ান অঞ্চল বলে যাকে জানত মানুষ, তার কিছু অংশ পড়েছে কসোভো, সার্বিয়া, গ্রিস ও বুলগেরিয়ায়।

চারপাশ ভূখণ্ডবেষ্টিত মেসিডোনিয়ান অঞ্চলের বাকিটা নিয়ে জন্ম হয় মেসিডোনিয়ার। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মেসিডোনিয়ার সঙ্গে গ্রিসের নাম নিয়ে বিবাদ চলছিল। দীর্ঘ ২৭ বছরের বিবাদের অবসান ঘটিয়ে ২০১৮ সালে দেশটির নামকরণ করা হয় উত্তর মেসিডোনিয়া। এই অঞ্চল থেকে আলেক্সান্দার দ্য গ্রেট, বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান দ্য গ্রেটরা নাম কুড়িয়েছেন ইতিহাসে। কিন্তু ফুটবলে? এক গোরান পানদেভ ছাড়া তেমন কেউ নেই।

ইতালিকে হারিয়ে ফুটবলবিশ্বকে বড় ধাক্কা দিল উত্তর মেসেডোনিয়া
ছবি: রয়টার্স

গত ইউরোয় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে উত্তর মেসিডোনিয়ার হয়ে শেষ ম্যাচ খেলা পানদেভ ইন্টার মিলানে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ও সিরি ‘আ’। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা উত্তর মেসিডোনিয়াকে একটু আলাদাভাবে মনে রাখতে পারেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসা নিকোলাই ইলিয়োভস্কি উত্তর মেসিডোনিয়ার, তাঁর হাত ধরে ঢাকায় লেবাননকে ২-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ।

পানদেভ যাওয়ার পর এখন অবশ্য আলেক্সান্দা ত্রায়েকোভস্কিকে নিয়ে মেতেছেন মেসিডোনিয়ানরা। এস্তাদিও রেনজো বারবারা স্টেডিয়াম ত্রায়েকোভস্কির হাতের তালুর মতো চেনা—সিরি ‘সি’তে খেলা পালের্মোয় ঘরের মাঠ, যে ক্লাবে ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত খেলেছেন ত্রায়েকোভস্কি। কাল রাতে এই মাঠেই যোগ করা সময়ের দুই মিনিটে তাঁর গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় ইতালির।

নিয়তির কী বিচার! একসময় ত্রায়োকোভস্কিই ছিলেন পার্লেমো–সমর্থকদের প্রিয় পাত্র, অথচ তাঁর গোলেই কিনা ইতালিয়ানদের হৃদয় ভাঙল!

হৃদয় ভেঙেছে জার্মানদেরও। গত বছর এপ্রিলে এই বিশ্বকাপ বাছাইয়েই জার্মানির ঘরে ঢুকে ২-১ গোলের জয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল উত্তর মেসিডোনিয়া। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ২০ বছরে সেটি ছিল জার্মানির প্রথম হার।

২০০৯ সালে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তখনকার ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেনের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে ৩-২ গোলে হারে উত্তর মেসিডোনিয়া। দলটি বিশ্বকাপে খেলার কখনো সুযোগ পায়নি। ১৯৩০ থেকে ১৯৯০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত সাবেক যুগোস্লাভিয়ার হয়েই খেলেছেন মেসিডোনিয়ার ফুটবলাররা।

স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উত্তর মেসিডোনিয়া অংশ নেয়নি। কিন্তু এরপর সব কটি বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নিয়ে কখনো চূড়ান্ত পর্বের টিকিট পায়নি দলটি। বড় টুর্নামেন্টের মধ্যে গত ইউরোই উত্তর মেসিডোনিয়ার প্রথম টুর্নামেন্ট।

২৪ দলের মধ্যে ২৩তম হয়ে ছিটকে পড়া সেই মেসিডোনিয়ার কোচ ব্লাগোয়া মিলিভস্কি ইতালিকে বিদায় করার ব্যাখ্যাটা দিলেন এভাবে, ‘দুটো শট থেকে একটি গোল—ইতালিয়ানদের খেলার ধাঁচেই আমরা ইতালিকে হারিয়েছি।’

গ্যারি লিনেকার টুইটে বুঝিয়েছেন এই হারের গভীরতা, ‘দুর্দান্ত! ডেথে (শেষ সময়ে) গোল করেছে উত্তর মেসিডোনিয়া। ইতালির বিশ্বকাপ–স্বপ্নও মৃত্যুপথযাত্রী...আবারও!’

অন্যদিকে মেসিডোনিয়া? তাঁদের উঠে আসার গতিপ্রকৃতি বোঝাতে আরেকটি তথ্য দেওয়া যায়। ২০১৬ সালে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে উত্তর মেসিডোনিয়ার এক ধাপ ওপরে ছিল মালয়েশিয়া (১৬১)। এখন সেই মালয়েশিয়া ১৫৪তম আর উত্তর মেসিডোনিয়া রোনালদো-ফার্নান্দেজদের হারিয়ে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখছে।