বদলে গেছে ইব্রাহিমের পৃথিবী

মোহাম্মদ ইব্রাহিম: পাদপ্রদীপের আলোয়
মোহাম্মদ ইব্রাহিম: পাদপ্রদীপের আলোয়

ভোর সাড়ে ৬টায় চকরিয়ায় বাড়ির পাশে বাস থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন বাবা মোহাম্মদ ইয়াসিন। কেঁদেই ফেললেন ছেলেকে পাঁচ মাস পর কাছে পেয়ে। এই ছেলে তো তাঁর সেই ছোট্ট ইব্রাহিম নয়, পরশু সন্ধ্যা থেকে ফুটবলের আলোচিত চরিত্র।
আবাহনীর বিপক্ষে মোহামেডানের জার্সি গায়ে জয়সূচক দুর্দান্ত এক গোল ইব্রাহিমের পৃথিবীটাকে দিয়েছে বদলে। সবাই ফোন করছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে। ফুটবলজীবনের শুরুতে এমন রঙিন দিনের দেখা পাবেন ভাবেননি। অথচ প্রিমিয়ার লিগের গুরুত্বপূর্ণ এই লড়াইয়ে একাদশে সুযোগ পাওয়া নিয়েই ছিলেন সংশয়ে।
ম্যাচের আগে একাদশে আছেন জেনে ১৮ বছরের তরুণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেন নিজেকে। তারপর মাঠে নেমে শেষ মিনিটে ওই দুর্দান্ত গোল, রাত ১০টায় কক্সবাজারগামী বাসে ওঠা...। বাড়ি পৌঁছে টের পেলেন দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ম্যাচে প্রথম নেমেই নায়ক বনে যাওয়ার স্বাদটা কী মধুর।
কাল বিকেলে ফোনে যখন ধরা হলো ইব্রাহিমকে, ও প্রান্তে তাঁর গলা কাঁপছে, ‘আমি স্বপ্নের ঘোরে আছি। সবাই ম্যাচটা টিভিতে দেখেছেন। মোহামেডানে খেলি বলে লোকে চেনে। এখন অচেনা লোকজনও চিনতে শুরু করেছে। সবাই গোলটার কথা বলছে।’
কিন্তু আবাহনী গোলরক্ষক জিয়া গোলটাকে ভুলে যেতে চান দ্রুতই। সতীর্থ প্রাণতোষের সঙ্গে কালই বাগেরহাটের বাড়িতে গেছেন। সেখান থেকে ফোনে অবশ্য ইব্রাহিমের প্রশংসাই করলেন বেশি, ‘ছোট ডির ভেতর বলটা সুন্দর রিসিভ হয়ে গেছে ওর। একটু সময় পেলে আমি হয়তো বেরোতে পারতাম। কিন্তু সুন্দর শটে দারুণ ফিনিশ করল সে।’
আবাহনীর অধিনায়ক প্রাণতোষের খুবই মনে ধরেছে ইব্রাহিমকে। এই সেদিনও তাঁর পাশে খেলেছেন ঘানার ইব্রাহিম। সাত-আট বছর পর গত মৌসুমে সেই ইব্রাহিম বিদায় নিয়েছেন আবাহনী থেকে। নতুন ইব্রাহিমকে আবাহনীতে এ বছর নিতে চেয়েও পারেননি প্রাণতোষ, ‘গতবার মুক্তিযোদ্ধায় ও ভালো খেলেছে। তাই দাদাকে (ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু) বলেছিলাম ওকে নিতে। তবে সে মোহামেডানের সঙ্গে কথা বলে ফেলায় তা সম্ভব হয়নি।’
ইব্রাহিম কাল সকালে পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে ক্লান্ত। প্রায় সব দৈনিকের খেলার পাতায় তাঁর ছবি। চকরিয়ায় রাস্তার বেরিয়ে দেখলেন, আরও অনেকেই ছবি দেখছে। এলাকার চেয়ারম্যানের শুভেচ্ছা পেলেন। কক্সবাজার বন বিভাগের অফিসের ড্রাইভার বাবা মিষ্টি খাওয়ালেন দেদার। ছেলের সাফল্যে গর্বিত বাবার কণ্ঠ কাঁপছিল ফোনে, ‘আজ যেন ঈদের আনন্দ আমার বাড়িতে।’
গরুর মাংসসহ নানা পদের রান্না। মায়ের হাতের সেসব খাওয়ার ফাঁকেই বাড়িতে মোটরসাইকেলে এসে হাজির কয়েক বন্ধু। ওঁরা তাঁকে নিয়ে গেল অনুশীলন মাঠে! বন্ধুদের তাড়া খেতে খেতে সেসবই বলে যান মোহামেডানের তরুণ তুর্কি।
‘মানিক স্যারের’ কথাও বলতে ভোলেননি। ২০১৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ দল গড়তে ট্রায়ালে ডেকেছিল মুক্তিযোদ্ধা। দলটির সে সময়ের কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক ফিরে তাকান পেছনে, ‘ওই ট্রায়ালে ওকে পছন্দ করি। প্রকৃতিদত্ত প্রতিভা আছে, ওকে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের অধিনায়ক করি। মুক্তিযোদ্ধাকে বাফুফের টুর্নামেন্টে রানার্সআপ করতে সে বড় অবদান রেখেছে। এরপর খেলার সুযোগ দিতে পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরের দল ঢাকা ইউনাইটেডে ওকে ধার দিয়েছিলাম। অল্প বয়স, শারীরিক গড়নও চমৎকার। তৃষ্ণা আছে। চেষ্টা করলে অনেক ভালো করবে।’
গত লিগের সময় এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। আগে-পরে মুক্তিযোদ্ধার কোচ মানিককে মোহাম্মদ ইয়াসিন বারবার বলেছিলেন, ‘আমার ছেলেটাকে দেখবেন।’ মানিক দেখেছেন, পরিচর্যা করেছেন। এখন পড়েছেন জসিমউদ্দিন জোসির হাতে। মোহামেডান কোচ অনেক উঁচুতে দেখতে চান ছাত্রকে, ‘ওর মধ্যে বড় খেলোয়াড় হওয়ার গুণ আছে।
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে অখ্যাত এক নবীনের পক্ষে গোল পাওয়া সহজ নয়। ইব্রাহিম পেয়েছেন বলেই তাঁর জীবনে হঠাৎ আলোর ঝলকানি।