বাংলাদেশের ফুটবল: এক ব্যর্থ প্রেমের গল্প

বাংলাদেশের ফুটবলে এমন দৃশ্যের অভাব নেই।প্রথম আলো ফাইল ছবি

ফুটবলে একটি দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে সবার চেয়ে।

পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল বলুন, কিংবা চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি-ইতালি। ফ্রান্স, আর্জেন্টিনাকেও বিপুল ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এমন তারকাখচিত ফুটবল ফেডারেশন আর আছে নাকি কোথাও! বাংলাদেশে ফুটবল খেলাটা চালানই দেশের ইতিহাসের সেরা ফুটবল তারকা। তাঁর সহযোগী হিসেবে অনেকেই আছেন, যাঁরা দেশের জার্সি গায়ে খেলেছেন, খেলোয়াড়ি জীবনে একেক জন ছিলেন বড় তারকা। উল্টো দিক দিয়েও বাংলাদেশ সেরা। তারকাখচিত ফুটবল ফেডারেশনের বিরোধী পক্ষেও আছেন প্রচুর তারকা। কিন্তু এত কিছুর পরেও ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশ ১৮৭। ২০৬ টি দেশের মধ্যে এই র‌্যাঙ্কিং ১৯৭-এ নেমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। বড় বড় তারকারা ছিলেন বলেই রক্ষা! তাঁরা টেনে-হিঁচড়ে কোনোমতে ১৮৭-তে তুলেছেন।

প্রশ্নটা অনেকেই করেন, যে দেশের ফুটবলে এত সাবেক তারকার সমাবেশ, সে দেশের ফুটবলের অবস্থা এমন কেন! খেলোয়াড়ি জীবনে এই মানুষগুলোই তো ফেডারেশন তাঁদের এই দিচ্ছে না, সেই দিচ্ছে না বলে আকাশ-বাতাস গরম করে তুলতেন। কিন্তু নিজেরা ফুটবলের নেতৃত্বে এসে দেখালেন যে লাউ সে-ই কদু!

বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলকে তীব্র ভালোবাসা দিয়েও বিনিময়ে কিছুই পায়নি।
ফাইল ছবি

অবাক করা বিষয়। বাংলাদেশের ফুটবলের সঙ্গে ক্রীড়াপ্রেমীদের সম্পর্কটা কেমন যেন ‘ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রেমের সম্পর্কের মতো। কেউ কেউ তো সরাসরিই বলে দেন, এটা একটা ব্যর্থ প্রেম। একটু চিন্তাশীল মানুষেরা বলতে পছন্দ করেন বাংলাদেশের ফুটবল আর ফুটবলপ্রেমীদের এই সম্পর্ক ‘একতরফা’। ঠোঁটকাটারা আরও এক কাঠি সরেস। তাঁরা বলেন, এ দেশের মানুষ সারা জীবন ফুটবলকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন ক্রিকেটকে।

যে যা-ই বলুন না কেন, ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কটা আসলে বেদনা-বিধুর। পঞ্চাশ বছরে পা রাখতে চলল এই দেশ, ফুটবলকে এত ভালোবাসল এ দেশের মানুষ, কিন্তু প্রাপ্তির ঘর প্রায় শূন্য। বিদেশের মাটিতে সাফল্য, বিভিন্ন টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়, বিশ্বকাপ, এশিয়ান কাপে খেলা—এসব বাদ দিন। সাধারণ প্রাপ্তিগুলোও মেটাতে পারেনি ভালোবাসার ফুটবল। এক সময় ঘরোয়া ফুটবল ছিল মানুষের আলোচনা-আগ্রহের কেন্দ্রে। সে অবস্থানও ধরে রাখা যায়নি। ব্যর্থতা এক জিনিস আর মানুষকে বঞ্চিত করা আরেক বিষয়। ফুটবল তো চিরদিন মানুষকে বঞ্চিতই করে গেছে। সারা দুনিয়ার সব দেশের মানুষ নিজেদের ঘরোয়া ফুটবল, ক্লাব-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো। এক সময়ের আগ্রহের খেলাটা নিয়ে এখন কথা বলতেও বিরক্ত বোধ করে মানুষ। ফুটবল মানুষকে ভালোবাসার প্রতিদান ঠিক এভাবেই দিয়েছে।

শুরুর কথায় ফেরা যাক। পৃথিবীর কোনো ফুটবল ফেডারেশনে অবশ্যই এত ‘তারা’র মেলা নেই।

ব্রাজিল-আর্জেন্টনা-জার্মানি-ইতালি কিংবা স্পেনের ফুটবল কারা চালায়। কে প্রধান, কে কোষাধ্যক্ষ, কে সহসভাপতি, সে সব দেশের ফুটবলপ্রেমীরা তাদের ঠিকমতো চেনে বলেও মনে হয় না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কিংবা লা লিগা মাঠে গড়াতে, দলবদল কবে হবে, আদৌ হবে কিনা, এসব সিদ্ধান্ত নিতে লিগ কমিটির ম্যারাথন সভারও প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর কোনো ফুটবল ফেডারেশনে নির্বাচন নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের মতো কাদা ছোড়াছুড়ি হয় না। এসব দিক দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যবান। মাঠে ফুটবলের অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, সব সময় জমজমাট ব্যাপার বাংলাদেশের ফুটবলে ঘটতেই থাকে। এ দেশের সংবাদপত্রে খেলার সংবাদ যত না ছাপা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ছাপা হয় প্রশাসকদের ইতিবৃত্ত। বাংলাদেশের ফুটবল সংবাদকর্মীদের ফুটবলীয় বিষয়াদি নিয়ে যত না প্রতিবেদন লিখতে হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি লিখতে হয় অ-ফুটবলীয় বিষয় নিয়ে।

এমন মাঠেই চলে ক্লাব ফুটবল।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

২০০৮ সালে বিপুলসংখ্যক সাবেক তারকা ফুটবলাররা যখন ফেডারেশনের নেতৃত্বে এলেন, তখন মনে করা হয়েছিল অনেক দিন ধরে চলে আসা ওই নেতিবাচক ব্যাপারগুলোর চিরদিনের জন্য দূরে সরে যাবে ফুটবল থেকে। ফুটবল নিয়েই কাজ হবে, দীর্ঘ দিনের অপ্রাপ্তিগুলো ঘুচবে, ফুটবল সাজবে নতুন রঙে। কিন্তু সে সবের প্রায় কিছুই হয়নি। সেই টেবিল গেম, কাদা ছোড়াছুড়ি, অ-ফুটবলীয় সংস্কৃতি চলছে। বাংলাদেশের ফুটবলের নেতৃত্বে থাকা সাবেক তারকা ফুটবলাররা এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেই পারেন। তাঁরা দীর্ঘদিনের চালু সংস্কৃতিটাই ধরে রেখেছেন, ঐতিহ্য রক্ষায় তাদের অবদান, অবস্থান বিশ্বে অতুলনীয়।

একই গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে খুবই পছন্দ করেন বাংলাদেশের ফুটবল সংগঠকেরা। বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র দেশ, যেখানে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই সংগঠকদের ফুটবল পরিচালনায়। এ দিক দিয়ে তাঁরা একটা স্বাতন্ত্র্যভাব বজায় রাখার রেকর্ডই গড়ে ফেলেছেন তারা। সারা দুনিয়ার ফুটবল যেভাবে চলে, এখানে চলে অন্যভাবে। সারা দুনিয়াতে ফুটবল ক্লাব আছে, যাঁরা নিজেদের একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, আর এখানে খেলার সংস্কৃতিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। এখানে ক্লাবগুলি ব্যস্ত রাজনীতিতে, দলবাজিতে। ফুটবল খুবই গৌণ এক বিষয়।

সোনালী অতীত বলতে ছিল জমজমাট ঘরোয়া ফুটবল। সেটাও তো হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
সংগৃহীত ছবি

কিছুদিন আগে তো দেশের তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোর বেশ কয়েকটিকেই জুয়ার ক্লাব হয়ে যেতে দেখল বাংলাদেশের মানুষ। ফুটবল ক্লাবে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা চলতে পারে, কিন্তু এই ক্লাবগুলোর ফুটবল-কার্যক্রম ঠিকমতো চলার লক্ষ্যে বিনিয়োগ কিংবা বিপণন কৌশল তৈরিতে যত অনীহা ক্লাব-কর্মকর্তাদের। পাতানো খেলার ব্যাপারগুলো তো আছেই। এই ক্লাবগুলোই বছরের পর বছর ধরে ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে প্রতারণ করেছে। গাঁটের পয়সা খরচ করে স্টেডিয়ামে গিয়ে মানুষ দেখেছে দুর্বল অভিনয় ও চিত্রনাট্যের নাটক। মানুষ ক্ষোভে ছটফট করেছে। চোখের সামনে অন্যায় দেখেছে, কিন্তু তারা কিছু করতে পারেনি। লেখার শুরুর দিকে বলা হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কটা বেদনা-বিধুর। ছলনা, প্রতারণা আর বঞ্চিত হওয়ার আখ্যান। এ থেকে মুক্তি মেলার কোনো লক্ষণ কি চোখের সামনে আছে?

আমাদের ফুটবল-সংগঠকেরা ‘হারানো ঐতিহ্য’ ফিরিয়ে আনার কথা খুব করে বলেন। কথা হচ্ছে, এ হারানো ঐতিহ্যটা কি! সোনালি অতীত বলে একটা কথা বাংলাদেশের ফুটবলে ব্যাপকভাবে আলোচিত। ফুটবলপ্রেমীরা বুঝে উঠতে পারেন না, সেই সোনালি অতীতটাই বা কি! একটা জিনিসই বোঝায়, সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ফুটবল এক সময় দারুণ কিছু ছিল। আমরা বিশ্বকাপে খেলতাম, এশিয়ান কাপে ঝড় তুলতাম, দক্ষিণ এশিয়ান কোনো প্রতিপক্ষই আমাদের কাছে পাত্তা পেত না, ব্যাপারটা এমনই তো? নিন্দুকেরা বলেন অন্য কথা, তাঁরা বলেন, আমাদের ফুটবল আবার কবে অমন আহামরি কিছু ছিল! কবে আমরা আন্তর্জাতিক ফুটবলে বলার মতো কোনো সাফল্য পেয়েছি?

আবাহনী–মোহামেডানের ঐতিহ্য, এ দুটি ক্লাব নিয়ে মানুষের আবেগও নষ্ট করেছি আমরা।
সংগৃহীত ছবি

এক সাফ গেমসে সোনা জিততেই তো আমাদের লেগে গেছে সাতটি আসর। দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের জাহির করেছি, হেরেছি নেপাল, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে। পাকিস্তানের কাছে তো আমাদের হারের হ্যাটট্রিকই আছে (১৯৮৭, ১৯৮৯, ১৯৯১ সালে পরপর তিনটি সাফে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে হেরেছি।) ফুটবলের যখন রমরমা অবস্থা। ঘরোয়া লিগ জমজমাট। তারকা খেলোয়াড়েরা বিকোচ্ছেন লাখ টাকায়, তখনই তো আমরা নেপালের কাছে হেরেছি। ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে নেপাল বাংলাদেশের মাটিতে এসে বাংলাদেশকে হারিয়ে গেছে বলে-কয়ে। ভারতের বিপক্ষে আমরা জিতেছি কালে ভাদ্রে। হারই সঙ্গী হয়েছে বেশির ভাগ সময়।

এশিয়ার বড় বড় শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে অবস্থা তো আরও সঙিন। জাপানের কাছে একবার আমরা ৮-০ গোলে হেরেছিলাম। আরব আমিরাতের কাছে খেয়েছিলাম ৭ গোল। ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে বেশির ভাগ স্কোরলাইনই চোখ দিয়ে দেখা যায় না। তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের ফুটবলের একটা ঐতিহ্য ছিল, ফুটবলের প্রতি মানুষের বড় আগ্রহ ছিল, আবাহনী-মোহামেডানের মতো ক্লাবগুলোকে নিয়ে মানুষ আবেগাপ্লুত হতো।

দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকার হাতে এখন ফুটবলের ভার। তারপরেও হতাশা আর অপ্রাপ্তির ব্যথাটা কখনোই যায়নি ফুটবলপ্রেমীদের।
সংগৃহীত ছবি

কিন্তু সেই আগ্রহ, সেই আবেগকে সঠিক রাস্তায় ব্যবহার করার যে ব্যাপার ছিল, সেগুলো করতেই বিপুলভাবে ব্যর্থ বাংলাদেশের ফুটবল-সংগঠকেরা। স্বাধীনতার পর দুই-একজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে মুষ্টিমেয়, মুখচেনা ফুটবল সংগঠকেরাই বাংলাদেশের ফুটবল চালিয়েছেন। মানুষের জীবনের নিয়মে তাদের ওই দলে শূন্যস্থান এসেছে, সেই শূন্যস্থান ভরাট করেছে নতুন কেউ, কিন্তু ফুটবলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই সংগঠকেরা কিংবা তাদের সুগ্রীব-দোসররাই যখন ফুটবল বদলে দেওয়ার ইশতেহার দেন, সেই ক্লাব-সংস্কৃতি পরিবর্তন, ফুটবল বিপণন সঠিকভাবে করা ইত্যাদি কথা আওড়ান—তখন তা কেবল ফাঁকা বুলি বলেই মনে হয়। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দেশের ফুটবলপ্রেমীরা তখন অন্য দেশের লিগ ম্যাচ দেখতে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। দেশের ফুটবল নিয়ে ভাবনাটা তখন তাঁদের কাছে মনে হয়, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা!

বেদনা-বিধুর সম্পর্ককে সঙ্গে নিয়ে কে-ইবা পথ চলতে চায় জীবনে।