বাংলাদেশ ফুটবলের যত 'পরীক্ষা'...

২০০১ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের গোলরক্ষক আমিনুল হক। ছবি: এএফপি
২০০১ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের গোলরক্ষক আমিনুল হক। ছবি: এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচটিকে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন ‘পরীক্ষা’ হিসেবে মনে করেন বেশিরভাগ ফুটবলপ্রেমীই। অনেকেই ‘আতঙ্কিত’ এই ম্যাচে বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ে। অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন পার্থের নিব স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় এই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বমানের ফুটবলের সামনে মামুনুল-জাহিদ-এমিলি-জামাল ভূঁইয়ারা আদৌ লড়াইটা করে যেতে পারবে কিনা! অনেকেই আবার রোমাঞ্চিত এই ম্যাচটিকে কেন্দ্র করে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে তারা মনে করেন বড় ব্যবধানে হেরে গেলেও বাংলাদেশের ফুটবলের সামনে নতুন একটা দিগন্তই উন্মোচন করে দেবে এই ম্যাচ।
গত এপ্রিলে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের যৌথ বাছাইপর্বের গ্রুপিং চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই আলোচনাটা খুব জোরালো। নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘শক্ত’ প্রতিপক্ষ কিনা! জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ইমতিয়াজ সুলতান জনি ব্যাপারটি দেখছেন একটু অন্যভাবে। জাতীয় দলে দীর্ঘ দিন প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মত, ‘চার বার বিশ্বকাপ খেলা ও ইউরোপভিত্তিক ফুটবলারের আধিক্য বিচারে অস্ট্রেলিয়া সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ হতেই পারে। সবচেয়ে বড় কথা, অস্ট্রেলিয়া এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন ও মাত্র এক বছর আগেই বিশ্বকাপ খেলা দল। এমন পরিস্থিতিতে কোনো দলের সঙ্গে বাংলাদেশ আগে কখনোই মাঠের লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়নি।
বাংলাদেশ অতীতে জাপান, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উজবেকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কাতার, সিরিয়া, কুয়েত, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতো এশিয়ার শীর্ষ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে একাধিকবার মাঠে নেমেছে। এই দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার বড় ব্যবধানে হারলেও কোনো কোনো ম্যাচে জোর লড়াই করেছে। এখনো পর্যন্ত এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের কোনো দলের বিপক্ষে জয়ের রেকর্ড না থাকলেও বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা খুব একটা কম নেই বাংলাদেশের। সে হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচটি বড় ধরনের পরীক্ষা হলেও এই ম্যাচটি নিয়ে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন ফুটবল সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দীর্ঘ দিন পর শীর্ষ মানের একটি দলের বিপক্ষে খেলে নিজেদের অবস্থানটা বুঝে নেওয়ার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে মামুনুল ইসলামের দলের সামনে।

২০০৬ এশিয়ান কাপ বাছাইপ​র্বে কাতারের খেলোয়াড়ের বিপক্ষে বল দখলের লড়াইয়ে আরিফ খান জয়। ছবি: এএফপি
২০০৬ এশিয়ান কাপ বাছাইপ​র্বে কাতারের খেলোয়াড়ের বিপক্ষে বল দখলের লড়াইয়ে আরিফ খান জয়। ছবি: এএফপি


এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশিবার মুখোমুখি হয়েছে ইরানের বিপক্ষে। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ খেলা ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম মোকাবিলা ছিল ১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপে। নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে এই একবারই এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ইরানের সঙ্গে প্রথম মোকাবিলায় ফল ছিল ৭-০। প্রবল প্রতিপক্ষ ইরানের বিপক্ষে ৫টি ম্যাচে মাঠে নেমে পাঁচটিতেই হারের শিকার হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ১৯৮৯ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে শেষবারের মতো এই ইরানের বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ হারে সমান তালে লড়াই করে। ঢাকার ফল ২-১ হলেও তেহরানের ফিরতি পর্বের খেলাটির ফল ছিল হৃদয় বিদারক। পুরো ম্যাচে প্রবল লড়াই করেও যোগ করা সময়ের গোলে সেদিন ইরানের কাছে হার মানতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।
ইরানের মতো জাপানের সঙ্গেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের দেখা হয়েছে পাঁচবার। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো জাপানের মুখোমুখি হয়ে (মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে) ৩-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর ১৯৮৬ সালের সিউল এশিয়ান গেমস ও ১৯৯০ সালের বেইজিং এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ জাপানের কাছে হেরেছিল যথাক্রমে ৪-০ ও ৩-০ গোলে। ১৯৯৩ সালে জাপানের মাটিতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে বাংলাদেশ শিকার হয়েছিল ভরাডুবির। টোকিওর সে ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরেছিল ৮-০ গোলে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হার। দুবাইয়ে পরবর্তী লেগে অবশ্য লড়াইটা মন্দ করেনি বাংলাদেশ। সে ম্যাচের ফল ছিল ৪-১।
এশিয়ার বিশ্বকাপ খেলা দল উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের ফল তুলনামূলক ভালো। এই দলটিকে ১৯৮৮ সালে দেশের মাটিতে রুখে দেওয়ার রেকর্ড আছে বাংলাদেশের (০-০)। ১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে প্রথম মোকাবিলায় বাংলাদেশ হেরেছিল ৩-২ গোলে। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের কায়েদে আজম ট্রফিতে বাংলাদেশ হারে ১-০ গোলে। এই দলের সঙ্গে সর্বশেষ দুটি লড়াইয়ে (দেশের মাটিতে) বাংলাদেশ হেরেছিল ৫-১ গোলে।
এশিয়ার ‘বিশ্বকাপ জায়ান্ট’ দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। ১৯৭৯ সালে কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কাপে বাংলাদেশ দলটির কাছে হেরেছিল ৯-০ গোলে। কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ অবশ্য প্রথম মুখোমুখি হয় ১৯৭৫ সালে মারদেকা কাপে। সে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ৪-০ গোলে। ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ার আরেকটি মারদেকা কাপে বাংলাদেশ হারে ৩-১ গোলে। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সর্বশেষ মুখোমুখি হয় আজ থেকে ২৩ বছর আগে, ১৯৯২ সালে। ব্যাংককে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ সে ম্যাচ হারে ৬-০ গোলে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ খেলা সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম মুখোমুখি হয় ১৯৮৮ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে। আবুধাবির সে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ৪-০ গোলে। ১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জাপানের মাটিতে প্রবল আমিরাতের বিপক্ষে প্রবল লড়াই করেছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে পেনাল্টি থেকে ১-০ গোলে বাংলাদেশকে হারায় আরব আমিরাত। এই দলটির সঙ্গে সর্বশেষ মোকাবিলা হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে। আবুধাবির সে ম্যাচে বাংলাদেশকে ৩-০ গোলে হারায় আমিরাত। বলা হয়নি, ১৯৯৩ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দুবাই পর্বে বাংলাদেশ আমিরাতের কাছে হেরেছিল ৭-০ গোলে।

১৯৯৯ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দৃশ্য। ছবি: এএফপি।
১৯৯৯ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দৃশ্য। ছবি: এএফপি।

সৌদি আরবের সঙ্গে প্রথম মোকাবিলাতেই চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসে ৪-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই লেগে এই সৌদি আরব বাংলাদেশকে হারিয়েছিল যথাক্রমে ৪-১ (কুয়ালালামপুর) ও ৩-০ (জেদ্দা) গোলে। ২০০১ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের দুই পর্বে (দুটি পর্বই অনুষ্ঠিত হয় দাম্মামে) বাংলাদেশ হেরেছিল ৩-০ ও ৬-০ গোলে।
চীনের বিপক্ষে ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়াডে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল ১-০ গোলে। চীনের সঙ্গে সে ম্যাচ ছাড়াও বাংলাদেশ খেলেছে আরও চারটি ম্যাচ। ১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপে প্রথম সাক্ষাতে চীনের কাছে বাংলাদেশ হেরেছিল ৬-০ গোলে। ১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চীনের সঙ্গে সর্বশেষ দুই মোকাবিলায় হার ছিল ২-০ গোলে (গুয়াংজু ও ঢাকা)।
এশিয়ার আরেক বিশ্বকাপ খেলা দল কুয়েতের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলেছে মাত্র দুটি ম্যাচ। ১৯৭৩ সালে মারদেকা কাপের প্রথম সাক্ষাতে কুয়েতের বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছিল ২-১ গোলে। ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ মোকাবিলায় (সিউল এশিয়ান গেমসে) বাংলাদেশ হেরে যায় ৪-০ গোলে।
এশিয়ার বিশ্বকাপ খেলা দলগুলোর পাশাপাশি শক্তিশালী উজবেকিস্তান, কাতার ও সিরিয়ার সঙ্গে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। উজবেকিস্তানের বিপক্ষে তিনটি লড়াইয়ের একটিতেও দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে প্রথম সাক্ষাতে (এশিয়ান কাপ বাছাই, আবুধাবি) বাংলাদেশ হেরেছিল ৬-০ গোলে। পরের দুটো ম্যাচে ফল ছিল যথাক্রমে ৪-০ (ঢাকা) ও ৫-০ (তাসখন্দ)। সিরিয়ার সঙ্গেও কিন্তু লড়াইয়ের ইতিহাস বাংলাদেশের। ১৯৮০ সালের এশিয়ান কাপে সিরিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। ১৯৮৪ সালের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ হেরে যায় ২-১ গোলে। ২০০৭ সালে দিল্লির নেহেরু কাপে সিরিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ লড়াইয়ে বাংলাদেশ হার মানে ২-০ গোলে।
২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজক কাতারকেও কিন্তু রুখে দেওয়ার রেকর্ড আছে বাংলাদেশের। তবে সেটা বহু বছর আগে, ১৯৭৯ সালে। সেবার এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে কাতারের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছিল বাংলাদেশ। এরপর অনেক পরে ২০০৬ সালের এশিয়ান কাপ বাছাই আবার কাতারের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। ঢাকার প্রথম লেগে ৪-১ গোলে হারলেও দোহায় বাংলাদেশ সেবার হেরে যায় ৩-০ গোলে।
এশিয়ার বিশ্বকাপ খেলা ও এই শীর্ষ দলগুলোর বাইরে বাহরাইন, লেবানন ও ইয়েমেনের সঙ্গে খেলেছে বাংলাদেশ। লেবানন ও ইয়েমেনের সঙ্গে বাংলাদেশের আছে জয়ের রেকর্ড। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে লেবাননকে ঢাকায় ২-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম লেগে বৈরুতে অবশ্য লেবানন জিতেছিল ৪-০ গোলে। ইয়েমেনের সঙ্গে বাংলাদেশ জিতেছিল ১৯৯৪ সালে কাতারের দোহায়, ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে। সে ম্যাচের স্কোরলাইন ছিল ১-০। ইয়েমেনের সঙ্গে ১৯৮৮ সালে আবুধাবির এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের আরও একটি ম্যাচে বাংলাদেশ গোলশূন্য ড্র করেছিল। বাহরাইনের সঙ্গে ১৯৭৯ সালের পর আর দেখা হয়নি বাংলাদেশের। সে ম্যাচটি বাংলাদেশ হেরেছিল ২-০ গোলে।
২০০০ সালের পর এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) স্তরবিন্যাসের কারণে এশিয়ার শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে লড়াইয়ের সুযোগ প্রায় হারিয়েই বসেছিল বাংলাদেশ। এই সময়ে এশিয়ার দ্বিতীয় স্তরের দলগুলোর সঙ্গে খেলেই আন্তর্জাতিক ফুটবলের স্বাদ নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল উজবেকিস্তান, কাতার ও লেবানন। ২০০৬ সালে এএফসির অধিভুক্ত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই ম্যাচটি দীর্ঘ বিরতির পর বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য তাই বড় মঞ্চে আরোহণও। এই ম্যাচটি বদলে দেবে দেশের ফুটবলের মানসিকতা, পরিস্কার করবে নিজেদের অবস্থান—এ কথা কিন্তু বলে দেওয়াই যায়।