বিশ্বকাপের সংসার

রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স
রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া বিশ্বকাপের সংসার এখন মাত্র ৮ দলের। ১১ শহরের ১২ স্টেডিয়ামের ছয়টির মেলা ভেঙে গেছে। সেখানে বিসর্জনের বাজনা। বাকি পাঁচটি নতুন চ্যাম্পিয়নের রাস্তা সাজাতে ব্যস্ত। আর সাত ম্যাচ পরই কোনো এক দল মাথায় তুলবে বিশ্বসেরার মুকুট। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। বোধন ও সমাপ্তির একই মঞ্চে। মুকুট পরার দাবি নিয়ে একেবারেই কাছাকাছি এসে গেছে আট দল। ব্রাজিল, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, উরুগুয়ে, রাশিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সুইডেন, ফ্রান্স— চ্যাম্পিয়ন বেছে নেওয়ার কাজটা এখন অনেক সহজ।

রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে পূর্বের উরাল পর্বতের কাছের ইয়েকাতেরিনবার্গ। সেখান থেকে দক্ষিণের কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী ককেশাস পর্বতমালায় ঘেরা সোচি, নিঝনি নোভগোরাদ, বাল্টিক সাগর তীরের সর্ব পশ্চিমের শহর কালিনিনগ্রাদ, দক্ষিণের রোস্তভ, সেন্ট পিটার্সবার্গ, কাজান, সামারা—অনেক বড় ছিল এই বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের ভ্রমণ। পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ। আগে কখনো একক দেশে এত দূর-দূরান্তের স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ হয়নি। ভ্রমণের ধকলটাই ছিল বড়। অবশ্য সব কটি শহর বৈচিত্র্যপূর্ণ।

আর এই বৈচিত্র্যের মধ্যে বিশ্বকাপ ২০০২ থেকে গড়ে তোলা একটা স্বভাব বদলাতে পারেনি। সেটি এই, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিদায় নিতে হবে প্রথম রাউন্ডেই।’ বিশ্ব মুকুট মাথায় পরে ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিয়েছিল ফ্রান্স। সেই যে একটা ঐতিহ্য তৈরি হলো, তারপর একই পথে হেঁটে ২০১০ সালে বিদায় নিল ইতালি, ২০১৪ ব্রাজিলে স্পেন।

রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স
রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স

এবার অবশ্য ভাবা যায়নি প্রথম রাউন্ডেই মুকুট খুলে রেখে যেতে হবে জার্মানিকে। দেশে রেখে আসা খেলোয়াড়দের দিয়ে দল গড়া যায় আরও দুটি, এমনই সমৃদ্ধ দল। কোচ জোয়াকিম লো গোটা ফুটবল বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছেন অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। আর সেই দলই কিনা প্রথম ম্যাচে হেরে গেল মেক্সিকোর কাছে। সুইডেনের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও জার্মানি চূড়ান্তভাবে রক্তাক্ত হলো দুর্বল এশিয়ার দল দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে।

জার্মানির বিদায়ের পর গেল মেসির আর্জেন্টিনা, রোনালদোর পর্তুগাল, এমনকি স্পেনও। শিরোপার অন্যতম দাবিদার ফ্রান্সের কাছে আর্জেন্টিনার পরাজয় অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে স্বাগতিক রাশিয়ার কাছে হেরে যাবে স্পেন? এটাই এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। সবচেয়ে বড় অঘটন। নিজেদের দল নিয়ে খোদ রাশিয়াই স্বপ্ন দেখেনি। যেখানেই গেছি, রুশ জনতার এতটুকু আগ্রহ দেখিনি আকিনফিয়েভদের নিয়ে। স্কুলের ছেলেরা হেসেছে, ‘ওরা ক্রুক ক্রুক...ওদের পা ভাঙা। প্রথম পর্বেই বিদায়।’ সেই রাশিয়া সৌদি আরবকে পাঁচ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুরু করল। দ্বিতীয় ম্যাচে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের মহাতারকা মোহামেদ সালাহর মিসরকে ৩-১ গোলে হারিয়েই পেয়ে গেল দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট।

কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলে কী হবে? সামনে যে পাসিং ফুটবলের গোলাপ ফোটানো স্পেন। আশার সমাধি ভেবে রুশ জনতার আগ্রহ নিভে গেল আবার । তারাই টাইব্রেকারে হারিয়ে দিল স্পেনকে!

বাস্তববাদী রুশরা সাফল্যে উৎসব করে সেটিও মেপে মেপে। তবে স্পেনের বিপক্ষে শেষ ষোলোর জয় যেভাবে কাঁপিয়েছে রাশিয়াকে, তেমনটি নাকি এ দেশেও অপ্রত্যাশিত ঘটনা। মস্কোয় সিগন্যাল বাতির ওপর উঠে লাফিয়েছে পাগলভক্ত। সামারায় রাত ৩টা পর্যন্ত নেভেনি উৎসবের রং। লেভ ইয়াশিন, রিনাত দাসায়েভ, ইগর বেলানভদের সোভিয়েত ইউনিয়ন একদা ছিল সম্ভ্রম জাগানো। কিন্তু সোভিয়েতের উত্তরসূরি রাশিয়া ফুটবলে হয়ে পড়েছে গরিব, অর্থনীতিতে ধনী। আয়োজক হিসেবে এই যে সাফল্যের মালাটা গাঁথা গেল, তাতে ফুটবলের সেই পুরোনো সড়কেই যেন নিজেদের আবিষ্কার করছে রাশিয়া। যেমনভাবে স্বপ্ন দেখছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিজাত অর্থনৈতিক বলয়ে ঢুকে যাওয়ার।

রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স
রুশদের এমন উল্লাস কখনো দেখা যায়নি। ছবি: রয়টার্স

ঘুষ দিয়ে ভোট কিনে আয়োজক—এই অপবাদ বহুদিন বয়ে বেড়াতে হয়েছে রাশিয়াকে। রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (তখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রী) বারবার বলে গেছেন, রাশিয়া আয়োজনেই দেখিয়ে দেবে তার সক্ষমতা। সেটি তারা এ পর্যন্ত দেখিয়েছে। বাকি ৮ ম্যাচে ( তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ ধরে) তা আরও বেশি করে দেখাতে না পারার কোনো কারণ নেই। পুতিন রুশ খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, ‘খেলার মাঠেও দেখিয়ে দাও আমরা যোগ্য আয়োজক।’ চেরিশেভ, আকিনফিয়েভ, গোলোভিনরা তা দেখিয়েছেন।

বিশ্বকাপে অতি পরিচিত ছবি ছিল পুতিনের সঙ্গে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর উষ্ণ সম্পর্ক। দুজন যেন সব সময়ই গলাগলি ধরে রয়েছেন। যেখানে পুতিন, সেখানেই ইনফান্তিনো।

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সব সময়ই বাঁকা চোখে তাকিয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপের দিকে। মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে। নিজেদের নাগরিকদের রাশিয়ায় বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে করেছে নিরুৎসাহী। অথচ মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়াম লাগোয়া স্পোর্তিভনায়া মেট্রো স্টেশনের কাছেই কয়েকজন আমেরিকানকে বিশ্বকাপের টিকিট কেনার জন্য ঘুরতে দেখেছি। ইংল্যান্ড ইংলিশদের বলেছে, রাশিয়ার এটা খারাপ, ওটা খারাপ। রাশিয়া গেলে বুঝেশুনে নিজের দায়িত্বে যেয়ো। সেই ইংলিশ ফুটবল ভক্তরাই রাশিয়া এসে অবাক। কই, কোথাও তো কিছু নেই! দেশটা কী সুন্দর। মেয়েগুলো কী সুন্দর। খেলার মাঠে ইংল্যান্ড অবশ্য রাশিয়ার সমর্থন পায়নি। কলম্বিয়া-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে তারা দক্ষিণ আমেরিকানদের জয় চেয়েছে। টাইব্রেকারে কলম্বিয়ার স্বপ্নভঙ্গে রুশদের মন খারাপ।

ইংল্যান্ড তাতে কিছু মনে করেছে বলে জানা নেই। তারা রুশদের আয়োজনে মুগ্ধ। শুধু ইংল্যান্ড কেন, প্রতিটি দেশের নাগরিকের মুখেই রাশিয়ার প্রশংসা।